বাংলা
Perspective

কাশ্মীরের ওপর নতুন দিল্লীর আক্রমণও এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই

গত সোমবার, ভারতের হিন্দু আধিপত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ, আধা-স্বায়ত্বশাসনের অধিকারকে অবৈধভাবে বাতিল করেছে। এই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীর অঞ্চল, যা গত সাত দশক ধরে পরমাণু শক্তিধর দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হয়ে চলা সামরিক-কৌশলগত শত্রুতার কেন্দ্রে রয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মির এতদিন ছিল ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য। নতুন দিল্লী জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে তাদের পদমর্যাদা হ্রাস করল এবং ক্ষমতা ভীষণ ভাবে কমিয়ে দিল। জম্মু ও কাশ্মীর এখন থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের অছির অধীনে থাকবে এবং তাদের "নির্বাচিত" সংসদ ও সরকার এখন কেবলই লোক দেখানো হয়ে গেল।

বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলের ম্যাপ [Source: Wikimedia Commons]

এই পরিবর্তন করা হল একটি সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ এবং ভারতের সামরিক ও গোয়েন্দা দফতরগুলির কয়েকজন প্রধান আধিকারিক এই অভ্যুর্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন।

এই পরিবর্তনগুলির বিষয়ে তর্ক করা দূরে থাক, জম্মু ও কাশ্মীরের এবং ভারতের সব জায়গার মানুষকে এই বিষয়ে আগে থেকে কিছু জানানোও হয়নি। তারা সোমবার সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলো যে বিশেষ ক্ষমতাবলে সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ পদমর্যাদা সংবিধান থেকে খর্ব করেছে এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক অভূতপূর্ব অবরোধ শুরু করা হয়েছে।

সপ্তাহের শেষে জম্মু ও কাশ্মীরে সকল ইন্টারনেট, কেবল টিভি, এবং মোবাইল ও ল্যান্ড ফোন পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। হাজার হাজার সৈন্য ও আধাসেনারা কার্ফিউ চালানোর কঠোর আদেশ পালন করছে। চার জনের বেশী মানুষের একত্রিত হওয়ার ওপর নিষেধ রয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মিরের "সম্পূর্ণ ভাবে একত্রিত" হওয়ার পন্থা শুরু হয়েছে ভারত রাষ্ট্রের ভারী সামরিক বুটের তলায়। চেন্নাইয়ে অবস্থিত হিন্দু পত্রিকা অনুযায়ি, ভারত রাষ্ট্রের এই ভারী সামরিক বুটের আওয়াজ ব্যাতিত কাশ্মির "ভারতের অন্যান্য জায়গার থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন"।

শ্রীনগর কাশ্মীরে ভারতীয় সামরিক বাহিনী

বিজেপি-র সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের একাধিক প্রতিক্রিয়াশীল লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • ১৯৮৯ থেকে পাকিস্তানের সমর্থনে জম্মু ও কাশ্মীরে যে ভারত বিরোধী বিদ্রোহ চলছে, নতুন দিল্লীর শর্ত মেনে তার দ্রুত ও রক্তাক্ত সমাপ্তি ঘটানো
  • পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে ভারতের কৌশলগত ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা
  • হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও হিংস্র জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা, যা দিয়ে হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের চালনা করা যায়। কাশ্মীরকে পদানত করা এবং ভারতের শ্রমিক ও শোষিত শ্রেণীকে ভাগ করা এবং ভয় দেখানোর আশা অনেক দিন ধরে ছিল এই হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের।

শেষের লক্ষ্যটি বিশেষ ভাবে জরুরি। বিজেপি সবেমাত্র একটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। কিন্তু তারা জানে যে তারা একটি সামাজিক বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছে। শ্রমিক শ্রেণীর বিরোধীতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সামাজিক ভাবে হিংসাত্মক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করার জন্য বড় ব্যবসাগুলিও তাদের চাপ বাড়াচ্ছে।

ভারতের অভিজাত শাসক শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে তথাকথিত সাংসদীয় বিরোধী দলও। তারা বিজেপি-র সাংসদীয় অভ্যূত্থানকে "উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এক জুয়া খেলা" বললেও, তাকে সমর্থন জানিয়েছে।

এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী। সব জায়গায়, সঙ্কটে পড়া ও ভয় পাওয়া অভিজাত শাসক শ্রেণীরা জটিল রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সামরিক সংঘাত সৃষ্টি করছে ও সংবিধানের বাইরে গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী, ইসলামিক ও জনপ্রিয়তাপন্থী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মঙ্গলবার এক ভয় পাওয়ানো দৃশ্যকল্পের কথা বলেন যা দ্রুত অবনত হবে "যুদ্ধের দিকে যতক্ষণ না আমরা নিজেদের শরীরের শেষ রক্তবিন্দুও দিয়ে দিচ্ছি"। এবং এই যুদ্ধের দৃশ্যকল্পে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারও রয়েছে। এমন একটি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী রূপে একটি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের রূপ নেবে।

ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিক শ্রেণীর এই সঙ্কটে অবশ্যই বুর্জোয়া আমলাতন্ত্রের সব দলের এবং কাশ্মীর, দক্ষিণ এশিয়া এবং সর্বত্র এই সকল বুর্জোয়া আমলাতন্ত্রের সব দলের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকের কার্য্যক্রম অনুসারে স্বাধীন ভাবে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন।

দেশভাগ এবং বুর্জোয়া শাসনের ব্যর্থতা

ক্রমবর্দ্ধমান সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের বিপদের বিষয়গুলিকে দুটি সম্পর্কযক্ত পদ্ধতির ফল হিসাবে বুঝতে হবে।

প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদ থেকে অকৃত্রিম স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য ভারতের জাতীয় আন্দোলনের অথবা অন্য যে কোনো গণতান্ত্রিক কাজ করার, যেমন জমিদারপ্রথা বা জাতভেদ রদ করার ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে প্রকাশ্য ব্যর্থতা। ১৯৪৭-এ মুসলিম পাকিস্তান ও প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে "স্বাধীন" হবার সময় উপমহাদেশের রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দেশভাগ এই ব্যর্থতারই সার সংক্ষেপ।

ইন্দো-পাকিস্তান আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব চালিয়ে যেতে এবং যুক্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক বিকাশকে ব্যর্থ করতে সাহায্য করেছে। এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের কারণেই যুদ্ধ এবং যুদ্ধের প্রস্তুতিতে বহু জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। আজ এই দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে এবং কার্যত সারা বিশ্বেকে এক পারমাণবিক হত্যাকান্ডের মত বিপদের সম্মুখীন করছে।

এই প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে বিশ্ব পুঁজিবাদের পদ্ধতিগত সংকট। এই বিষয়টি সব জাতীয় বুর্জোয়া চক্রকে বাধ্য করছে শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করার কাজটি নাটকীয় ভাবে আরও প্রবল করে তুলতে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সামনে রেখে আগ্রাসন ও যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের স্থান পোক্ত করতে।

১৯১৯ থেকে ১৯৪৭-৪৮ পর্যন্ত তিন দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়া যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ আন্দোলনে ডুবে ছিল, তাতে মুক্তি সম্ভাবনা প্রবল ছিল। কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় এবং তাকে ভ্রূণেই বিনষ্ট করা হয়।

বুর্জোয়াদের প্রধান দল, মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে বলে দাবি করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে নিজেদের সম্পত্তির জন্য প্রবল আসক্তি ছিল। এছাড়াও তারা দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিক ও শোষিতদের তাদের শ্রেণী স্বার্থের জন্য একত্রিত করার বিরোধী ছিল, এবং এই কাজ করতে অসমর্থও ছিল।

১৯৩০-এর দশকে এবং বিশেষ করে ১৯৪২-৪৭-এ, যখন ব্রিটিশের শাসনে পরাধীন ভারতে বৈপ্লবিক উত্থানের স্রোত বইছিল, তখন শ্রমিক শ্রেণীর শক্তি ও তাদের স্বাধীন হস্তক্ষেপ দেখে কংগ্রেসের নেতারা লন্ডনের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়ে, যাতে তারা ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে পায় এবং বুর্জোয়া শাসন স্থাপন করতে পারে।

গমনোদ্যত ঔপনিবেশিক প্রভুর দল এবং সাম্প্রদায়িক, জমিদার-শাসিত মুসলিম লিগের কাছে স্বাধীনতার উদ্যোগ আত্মসমর্পণ করে কংগ্রেস দেশভাগকে কেবল মেনেই নেয়নি, ১৯৪৭-এর শেষ বসন্ত ও গ্রীষ্মে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে জোট বেঁধে তারা পাঞ্জাব ও বাংলার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পক্ষে সাওয়াল করে।

এক দূরদর্শী বিশ্লেষণ করে ভারতীয় বলশেভিক লেনিনিপন্থী পার্টি (বি-এল-পি-আই)-এর ট্রটস্কিপন্থীরা এই বিশাল ঘটনার ঘনঘটার মধ্যেও প্রকাশ করে দেয় সেই দুই মিথ্যা কংগ্রেস যার ভিত্তিতে দেশভাগকে সমর্থন করার কথা বলছিল – যে তারা "সাম্প্রদায়িক সমস্যা"-র সমাধান করবে এবং "স্বাধীনতার রাস্তা খুলে দেবে"।

অপরদিকে, বি-এল-পি-আই সাবধান করে এই ব্যবস্থা "সাম্রাজ্যবাদী ক্রীতদাসপ্রথায়" "শৃঙ্খলবদ্ধ করার পন্থা", যা আন্তঃরাষ্ট্রীয় জাতিগত-সম্প্রদায়গত বিরোধ জাগিয়ে তুলবে, এবং "প্রতিটি রাজ্যে" সাম্প্রদায়িকতা "বৃদ্ধি করবে"। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ধরণের মানুষকে একত্রিত করার প্রগতিশীল কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব কেবলমাত্র সব প্রকারের বুর্জোয়া-সাম্প্রদায়িক লড়াই এবং বুর্জোয়া শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমেই। বি-এল-পি-আই বলে, "বুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়াশীল পদ্ধতিতে যাদের বিচ্ছিন্ন করেছে, কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীই তাদের প্রগতিশীল ভাবে এক করতে পারে"।

কাশ্মীর এমন এক উন্মুক্ত ক্ষত যা এই পর্যালোচনাকে এবং দেশভাগের কারণে জন্ম নেওয়া দুই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে সঠিক প্রমাণ করে। সাত দশক ধরে নতুন দিল্লী ও ইসলামাবাদ কাশ্মীরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করেছে। ১৯৪৭-৪৮-এর পর থেকে কাশ্মীরকে পৃথিবীর সর্বাধিক সুরক্ষিত সীমানাগুলির একটির দ্বারা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১৯৮৯-এ একটি রাষ্ট্রীয় নির্বাচনে কারচুপির পর জন্ম নেওয়া বিদ্রোহের বিরুদ্ধে নতুন দিল্লী জম্মু ও কাশ্মীরে এক "নোংরা যুদ্ধ" চালিয়েছে। এই যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে বহু অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং সংক্ষিপ্ত হত্যা। তারা বেড়ে চলা গণ প্রতিরোধকে অবজ্ঞা করেছে। অন্যদিকে, জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় শাসন নিয়ে তৈরী হওয়া ক্ষোভ ও ঘৃণাকে লাগিয়ে ইসলামাবাদ নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল কৌশলী স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কাশ্মীরে যে সব ইসলামপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও জাতি নির্মূল কর্মে যোগ দিয়েছে, ইসলামাবাদ তাদের যৌক্তিক সমর্থন জুগিয়েছে।

স্বাধীনত্তোর যুগে, পাকিস্তান দ্রুত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গী হিসাবে নিজেদের তৈরী করে শীতল যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রদেশ হিসাবে কাজ করতে। পাকিস্তান রাষ্ট্র যতদিন ধরে রয়েছে তার প্রায় অর্ধেক সময় ধরে পাকিস্তানে শাসন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক একনায়করা।

তাদের দিকে ভারতীয় বুর্জোয়ারা যুদ্ধোত্তর কালে বাজার বেড়ে ওঠার সুযোগ নেয়। এছাড়াও তারা একটি সোভিয়েত সমর্থনের সুযোগ নেয়, যার লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী উন্নয়ন প্রকল্প। যদিও এই প্রকল্পের ফলে অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র, ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাস ও অজ্ঞানতার শিকার হয়, তবু একে তারা আশ্চর্যজনক ভাবে নাম দেয় "কংগ্রেস সমাজতন্ত্র"। একই ভাবে তারা বিশ্ব মঞ্চে "সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী" নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকার ভান করে।

কিন্তু তাদের পাকিস্তানী প্রতিযোগীদের মতন ভারতীয় বুর্জোয়ারাও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের মতনই বেড়ে চলা সামাজিক বিরোধ থেকে নজর সরাতে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের যে সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি আছে তার নামমাত্র প্রতিভূ হল কংগ্রেস, যারা ক্রমাগত এক হিন্দুবাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বেশী স্থান দিয়েছে। তারা সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ও যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কংগ্রেসের ইন্ধনে শুরু হওয়া ১৯৮৪-র শিখ-বিরোধী দাঙ্গা এবং ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংস।

ভারতীয় বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আলিঙ্গন করে

যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে বিশ্বায়ন শুরু হয় এবং স্তালীনপন্থী আমলাতন্ত্রের রাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদ পুণরুদ্ধারের প্রচেষ্টা নিজের থাবা বের করে, ভারতীয় বুর্জোয়ারা তাড়াতাড়ি তাদের সমাজতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলে দেয়। কংগ্রেস পার্টিকে সামনে রেখে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে কাছের সম্পর্ক এবং বিশ্ব পুঁজির কাছে ভারতকে সস্তা শ্রমের জায়গা হিসাবে তুলে ধরার ভিত্তিতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নতুন জুটি গড়ে তোলে।

১৯৯১-এর পরে ভারতের "উত্থান"-এর ফল ভোগ করছে এক ক্ষুদ্র পুঁজিবাদী অভিজাত শ্রেণী যারা শ্রমিকের শ্রমের এবং জনগণের সম্পদ বিক্রির লাভ ভোগ করেছে। ভারতের সামাজিক অসাম্য এবং মানুষের দুর্দশা বিশ্বের সর্বোচ্চ গুলির মধ্যে অন্যতম।

তবুও বুর্জোয়ারা প্রবল ভাবে উদ্বিগ্ন এবং অসন্তুষ্ট। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অশান্তি এবং তীব্র ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবস্থার মধ্যে তারা ভয় পাচ্ছে যে উৎপাদনের কেন্দ্র হিসাবে ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গড়ে তোলার এবং আরও ক্ষমতা হাতে পাওয়ার "সুযোগের বাতায়ন"-টি দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

নব্য-উদারনৈতিক পুণর্গঠন দ্রুততর করতে ও বিশ্বমঞ্চে তাদের স্বার্থকে আরও জোরের সঙ্গে জানাতে কর্পোরেট ভারতবর্ষ মোদিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তার দক্ষিণপন্থী বিজেপি-কে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে স্থান দিয়েছে।

মোদি সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে "খেলার নিয়ম" বদলে দিতে বদ্ধপরিকর, কারণ বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হতে গেলে তাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে হবে। ভারতীয় পুঁজিবাদকে "বৃদ্ধি" করতে তেল ও অন্যান্য সম্পদে নিজেদের অধিকার কায়েম করতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু করে তারা বেড়ে চলা শ্রেণী সংগ্রামের পরিবেশে নিজেদের দেশে সামাজিক উত্তেজনাকেও বিপথে চালিত করতে চায়।

তাদের পূর্বসূরি কংগ্রেস পার্টির তৈরী করা ভারত-মার্কিন "বিশ্বব্যাপী কৌশলগত জুটি"-র ওপর ভর করে মোদি সরকার চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক-কৌশলগত আক্রমণের যথার্থ সামনের সারির রাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের লক্ষ্যে ওয়াশিংটনের উন্মাদের মতো দৌড়ে ভারত তাদের উপাদন দিয়ে সমর্থন ও উৎসাহ প্রদান করছে।

ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগত বন্ধুতা লক্ষণীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছে, যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেপরোয়া প্রচার চালাতে নতুন দিল্লীকে উৎসাহ প্রদান করছে।

ভারত-মার্কিন মৈত্রের ফলে চীন ও পাকিস্তান তাদের বহুদিনের সামরিক-কৌশলগত বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।

যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন গড়ে তোলো

ভারত-পাকিস্তান এবং ব ভারত-চীন দ্বন্দ্ব জড়িয়ে পড়ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বন্দ্ব বেড়ে চলেছে। এই বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়া ও সারা বিশ্বের জনগণের জন্য প্রবল বিপদ ডেকে আনছে। এর ফলে এই তিনটি দ্বন্দ্বেই অতিরিক্ত বিস্ফোরনের সম্ভাবনা যোগ দিয়েছে এবং বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলকে অতিরিক্ত ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব প্রদান করেছে।

চীনের স্বায়ত্ত্বশাসিত তিব্বত এবং জিনজিয়াং অঞ্চলের সীমানায় কাশ্মীর অবস্থিত। যুদ্ধ বা সামরিক সংকটের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন চীনের বন্দরগুলিকে অবরোধ করার পরিকল্পনা করলে ঘুরে যাওয়ার উপায় হিসাবে বেইজিং যে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, তা পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে পড়ছে।

গত তিন দশক কেবলমাত্র ভারতীয় বুর্জোয়াদের দক্ষিণপন্থায় ঝুঁকে পড়ারই সাক্ষী থাকেনি। ভারতে এবং সারা দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর আকার ও সামাজিক শক্তিও প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী নির্মমতা, সামাজিক অসাম্য এবং সামরিকতার বিরুদ্ধে সচেতন ভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর উত্থান ঘটে চলেছে এবং বেড়ে চলেছে।

এই শক্তিই সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া এবং যুদ্ধের প্রতিষেধক। নতুন দিল্লী ও ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে ভারত, পাকিস্তান ও উপমহাদেশ জুড়ে শ্রমিকদের শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। লিও ট্রটস্কি দ্বারা প্রথম বর্ণিত চিরকালীন বিপ্লবের কৌশলের ভিত্তিতে তাদের প্রয়োজন একে অপরের সঙ্গে যোগ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রাম করা এবং বিশ্ব জুড়ে যত শ্রমিক আছেন, তাদের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের সংগ্রামকে একত্রিত করা।

সাম্রাজ্যবাদের থেকে স্বাধীন হওয়া, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জাতির মানুষের সত্যিকারের সমান ভিত্তিতে এক হওয়া, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপ্রথা দূর করা, কাজ ও উপযুক্ত আয় এবং মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা – এ সবই সম্ভব কেবলমাত্র শোষিত শ্রেণীর সঙ্গে এক হয়ে শ্রমিক শক্তি সৃষ্টি করে।

এই কার্য্যক্রমের জন্য লড়াই করতে প্রয়োজন স্তালীনপন্থা এবং তাদের অন্য এক রূপ মাওপন্থার বিরুদ্ধে এক রাজনৈতিক সংগ্রাম, কারণ স্তালীনপন্থা ও মাওপন্থা দশকের পর দশক ধরে জাতীয়তাবাদ দিয়ে এবং বুর্জোয়াদের তথাকথিত কোনো না কোনো প্রগতিশীল দলের সঙ্গে শ্রমিকদের বেঁধে রেখেছে। এই সমস্ত দলগুলি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সি-পি-আই)-এর রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে সমর্থন করে, যা শ্রমিক শ্রেণীকে কংগ্রেস পার্টি ও মুসলিম লিগের কাছে অবদমিত রেখেছিল।

দশকের পর দশক ধরে সি-পি-আই এবং তাদের বৃহত্তর প্রশাখা, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে তারা কেন্দ্রে একের পর এক দক্ষিণপন্থী সরকারকে সমর্থন করেছে, যাদের অধিকাংশই ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন এবং যারা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সখ্যতা এবং নব্য-উদারনৈতিক সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে গেছে; ভারতের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকে সমর্থন করেছে, যাকে এখন ইন্ধন জোগাচ্ছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সামরিক বাজেট; এবং ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের ওপর মোদির সামরিক আক্রমণকে সমর্থন করেছে।

মে মাসে মোদি পুণর্নিবাচনের পর তারা শ্রমিক শ্রেণীকে কংগ্রেস, অন্যান্য বুর্জোয়া দল, এবং ভারতীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পচন্ ধরে যাওয়া "গণতান্ত্রিক" প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রিত করতে তাদের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করেছে।

তবুও বিংশ শতকের প্রথম থেকে শুরু হওয়া মহান সামাজিক সংগ্রাম দেখিয়ে দিয়েছে যে সামাজিক বিপ্লবের লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আন্দোলিত করেই কেবলমাত্র প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধের সফল বিরোধীতা করা সম্ভব।

আমরা ভারত ও পাকিস্তানে সমস্ত ডাব্লু-এস-ডাব্লু-এস পাঠকদের কাছে আবেদন করছি তাদের নিজেদের দেশে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের ইন্টারন্যাশনাল কমিটির শাখা তৈরী করে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে যোগ দিতে।

Loading