বাংলা

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তেজনা জাগিয়ে তুলতে ভারত সরকার কাশ্মিরে হওয়া আক্রমণকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে

ভারতীয় কাশ্মিরে গত বৃহস্পতিবারের আত্মঘাতী বোমাবাজিতে ৪০ জন ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যুর মারা যাবার জবাবে ভারত ভীতি প্রদর্শন করছে এবং রক্ত হিম করা হুমকি দিচ্ছে - পাকিস্তানের ওপর শীঘ্রই সামরিক হামলা করার কথা ঘোষণা প্রকাশ্যে ঘোষণা না করেও সবই করছে।

গতকালের ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র প্রধান নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানকে এই আক্রমণের জন্য দায়ী করেছেন। তিনি তারপর প্রতিজ্ঞা করেছেন যে ভারত "সন্ত্রাসবাদী দলগুলি এবং তাদের যারা সাহায্য করছে এবং উস্কানি দিচ্ছে - তাদের সবাইকে এর মূল্য দিতে বাধ্য করবে।"

"আমি দেশবাসীকে নিশ্চিত ভাবে বলি," মোদি আরও বলেন, "এই আক্রমণের পিছনে যারা আছে, এই আক্রমণের ষড়যন্ত্রকারীরা - তাদের শাস্তি পেতেই হবে।" তিনি বলেন তার সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে "যে কোনো কাজ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে"।

মোদি ক্রমাগত দম্ভ করে গেছে যে সেপ্টেম্বর ২০১৬-তে জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে হওয়া এক জঙ্গী হামলার বদলা নিতে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে যে সামরিক আঘাত হানতে আদেশ দিয়েছিলেন, তা ভারতকে "কৌশলগত সংযম"-এর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছে।

যুদ্ধ-জ্বর জাগিয়ে তুলতে মোদি গতকাল ঘোষণা করেন: "মানুষের রক্ত ফুটছে...আমাদের প্রতিবেশী দেশ, যারা আন্তর্জাতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন, তারা এক বিভ্রান্তির ঘোরের মধ্যে রয়েছে, [এবং] ভাবছে যে

এরকম জঙ্গী আক্রমণ আমাদের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারবে; কিন্তু তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না।"

বৃহস্পতিবার বিকালে জম্মু কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় যখন একজন আত্মঘাতী জঙ্গী বিস্ফোরক ভরা একটি এস-ইউ-ভি গাড়ি শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়েতে সি-আর-পি-এফ-এর বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়, তখন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সি-আর-পি-এফ)-এর আধা-সামরিক বাহিনীর অন্তত ৪০ জন সদস্য মারা যান এবং আরও বহু আহত হন। সি-আর-পি-এফ এর এই বাসটি ৭৮টি গাড়ির কনভয়ের একটি ছিল। এই কনভয়ে ২৫০০-এরও বেশী সেনা, যাদের বেশীর ভাগই ছুটিতে গিয়েছিল, তারা জম্মু কাশ্মিরের সবচেয়ে বড় শহর শ্রীনগরে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ফিরছিল।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে এই আক্রমণ - যা গত তিন দশকে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ক্ষতি ঘটিয়েছে - তা সফল হবার জন্য গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ত্রুটিই দায়ী।

ইসলামপন্থী, কাশ্মীর-পন্থী জইশ-ই-মহম্মদ (জে-ই-এম) এই আক্রমণের দায় স্বীকার করেছে - এই বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নতুন দিল্লী অবিলম্বে ঘোষণা করে যে এই আক্রমণের জন্য পাকিস্তান দায়ী।

গতকাল নতুন দিল্লি পাকিস্তানকে কঠিন শব্দবন্ধে ভরা রাজনৈতিক শাস্তি প্রদান করে - ইসলামাবাদ থেকে তাদের দূতকে ফিরিয়ে নেয় এবং ঘোষণা করে যে তারা পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রিয় ব্যবসায়িক দেশ-এর মর্যাদা বাতিল করছে। এ সবই এই ইঙ্গিত দেয় যে মোদি এবং তার দল বি-জে-পি বেড়ে চলা সামাজিক ক্রোধ থেকে মুখ ফেরাতে যুদ্ধমুখী জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তুলতে এবং তাদের প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক আসনকে দৃঢ় করতে বৃহস্পতিবারের জঙ্গী আক্রমণকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের বিষয়ে সব বিরোধীতাকে "জাতীয় ঐক্যের" প্রতি হুমকি বলে ধরা হবে।

ইদানিং কালে ক্রমবর্দ্ধমান শ্রমিক ও কৃষক প্রতিরোধ মোদি সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই প্রতিরোধের মধ্যে অন্যতম জানুয়ারি মাসের দুই দিনের দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট, যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কৃষক অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়াও তিনটি হিন্দীভাষী অঞ্চলের রাজ্য, যেগুলিকে আগে বিজেপির শক্তিশালী ঘাঁটি বলা হতো, সেখানে গত ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হয়। এর ফলে এখন এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে যে এপ্রিল ও মে মাসে একাধিক পর্বে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তাতে কি বিজেপি আদৌ জয়ী হতে পারবে।

গতকাল বিজেপি ও তাদের হিন্দুত্ববাদী মিত্ররা নতুন দিল্লি সহ বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত করে, যেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করা হয়।

কাশ্মিরের ঘটনাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিজেপি-র ক্ষমতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে তথাকথিত বিরোধী দলগুলির ভূমিকা। শাসক বিজেপি-র সঙ্গে তাদের কৌশলগত পার্থক্য যা-ই হোক্‌ এবং তারা বিজেপি-র যতই সমালোচনা করুক, তারা সকলেই ওই অঞ্চলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নতুন দিল্লির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে উগ্র হয়ে ওঠাকে প্রবল ভাবে সমর্থন করে।

কংগ্রেস পার্টি-র সভাপতি রাহুল গান্ধী এই ঘটনাকে "ভারতের আত্মার ওপর আক্রমণ" বলে নিন্দা করেছেন এবং বিজেপি সরকারকে আস্বস্ত করেছে যে তার দল এবং সমগ্র বিরোধীরা সরকার ও সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্থন করছে। "আমি পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই", গান্ধী বলেন, "যে সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই দেশকে ভাগ করা এবং তারা যতই চেষ্টা করুক, আমরা এক মুহূর্তের জন্যেও ভাগ হবো না।"

কংগ্রেস এবং অন্য সকল বিরোধী দলগুলি, যাদের মধ্যে রয়েছে স্তালীনপন্থী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বা সি-পি-এম, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মোদির "সার্জিকাল স্ট্রাইক"-কে সমর্থন করে এবং তা সফল করার জন্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রশংসা করেছে। ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালায়, সি-পি-এম-এর মুখ্যমন্ত্রী এবং পলটব্যুরো সদস্য পিনারাই বিজয়ন "সার্জিকাল স্ট্রাইক"-এর প্রশংসায় রাজ্য পরিষদে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপিত করেন।

ভারতের একমাত্র মুসলিম-গরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মিরের জনগণের বিরোধীতা বিজেপি সরকার যে নৃশংসতার সঙ্গে দমন করছে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের যে যুদ্ধমুখী নীতি, তার কেবল অতি সামান্য সমালোচনা করেছে স্তালীনপন্থীরা।

ভারতের পূর্ববর্তী কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের নীতি আরও কঠোরভাবে প্রনয়ণ করে মোদির বিজেপি নেতৃত্ব পাকিস্তানকে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে এবং যতক্ষণ না ইসলামাবাদ প্রমাণ দিচ্ছে যে তারা ভারতের নেতৃত্বাধীন কাশ্মিরে সমস্ত জঙ্গী দলগুলিকে সমর্থন করা বন্ধ করছে, ততক্ষণ তারা পাকিস্তানের সঙ্গে উচ্চ-স্তরে কোনো আলোচনা করবে না।

সি-পি-এম-এর পলিটব্যুরো তৎক্ষণাৎ বিবৃতি জারি করে যে তারা "জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামাতে একটি সি-আর-পি-এফ কনভয়ের ওপর হওয়া সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের তীব্র নিন্দা করছে।" তারা ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জন্য তাদের সমর্থনের কথা পুণরাবৃত্তি করে এবং ঘোষণা করে: "যে কর্মরত সেনারা তাদের প্রাণ দিয়েছেন, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সি-পি-এম পলিটব্যুরো আন্তরিক সমবেদনা জানায়।"

জানা গেছে যে বৃহস্পতিবারের আত্মঘাতী হামলাটি করেছিল ২০ বছর বয়সী কাশ্মিরি শ্রমিক আদিল আহমেদ দার। যেখানে সে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তার থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই বড়ো হয়ে উঠেছিল আদিল। তার অভিভাবকদের মতে, তাকে এবং তার বন্ধুরা যখন তিন বছর আগে স্কুল থেকে ফিরছিল, তখন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে এবং তারপর তাদের ওপর অত্যাচার করে। এর পরেই আদিল বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভারতের বিধ্বংসী হুমকির জবাবে পাকিস্তান এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট সংযমী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং পুলওয়ামা আত্মঘাতী হামলাতে কেবল মাত্র নিজেদের কোনো ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছে। এর আগের কিছু ঘটনায়, ভারতীয় আক্রমণের কথার জবাবে ইসলামাবাদ নিজেরাও সামরিক প্রতিশোধের রক্ত জল করা হুমকি দিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল তাদের পারমাণবিক শক্তির দম্ভ করা। এখন দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কিছু দেশ এই আক্রমণের নিন্দা করে বিবৃতি দেওয়ায় এবং ভারতের "সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী সংগ্রামের" পক্ষে তাদের সমর্থন জানানোয় পাকিস্তান খানিকটা ভয় পেয়েছে।

গতকাল, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন ওয়াশিংটনকে পাকিস্তানের ওপর ভারতের আক্রমণ করার বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছে। বল্টন সংবাদমাধ্যমকে জানান যে বৃহস্পতিবারের বোমা বিস্ফোরণের পরে তিনি ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে দু'বার কথা বলেছেন। তিনি জানান, "আমি আজ অজিত ডোভালকে বলেছি যে আমরা ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করি।" আগে হোয়াইট হাউস পাকিস্তানকে সব সন্ত্রাসবাদীদের "নিরাপদ আশ্রয়"-কে ধ্বংস করার দাবি করেছিল, তারই ওপর আবারো জোর দেয়।

কাশ্মির সমস্যা এবং বৃহত্তর ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের শিকড় পোতা রয়েছে ১৯৪৭-এ উপমহাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক বিভাজনে। উপমহাদেশকে মুসলিম পাকিস্তান ও হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে ভাগ করার কাজ একক ভাবে করেছিল বিদায়ী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুরা এবং বুর্জোয়াদের প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্প্রদায়িক শাখাগুলি, যাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম লিগ এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।

স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তান - দুই দেশই সমগ্র কাশ্মিরকে তাদের বলে দাবি করে। ফলে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কাশ্মির দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে - ভারতের রাজ্য জম্মু ও কাশ্মির-এ এবং পাকিস্তানের অধীনস্থ আজাদ কাশ্মির-এ। তাদের ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা পূরণ করতে ভারত ও পাকিস্তানের অভিজাত শাসক শ্রেণী কাশ্মিরের মানুষের অধিকারকে খর্ব এবং দলিত করেছে।

বহু দশক ধরে নতুন দিল্লি জম্মু ও কাশ্মিরের নির্বাচনকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে এবং ইচ্ছা মতো সরকার ফেলে দিয়েছে। ১৯৮০-র শেষ দিকে জণগণের দ্বারা সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দমন করতে তারা নির্মম ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, ভারতের ক্ষতি করতে পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মিরের বিরোধীদের স্বকার্য্যে লাগিয়ে ইসলামপন্থী জঙ্গী দলগুলিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

গত বৃহস্পতিবারের আক্রমণের "প্রতিশোধ" নিতে মোদি সরকার এখন পাকিস্তানের থেকে মাংস চাইছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার বিরোধী পারমাণবিক শক্তিরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার এক প্রবল বিপদের সম্ভাবনা আছে। সেপ্টেম্বর ২০১৬-তে ভারতের তথাকথিত "সার্জিকাল স্ট্রাইক"-এর পর বেশ কয়েক মাস দুই দেশ সর্বক্ষয়ী যুদ্ধের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। প্রায় প্রতিদিন গোলাগুলি চলত এবং দুই দেশেরই বহু সেনার ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হত।

চীনের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক-কৌশলগত আক্রমণে ভারতকে ব্যবহার করার মার্কিন প্রচেষ্টা এই অবস্থাকে আরও বিধ্বংসী করে তোলে। এর ফলে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ ক্রমে বেড়ে চলা চীন-মার্কিন উত্তেজনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ওয়াশিংটনের মিত্র নতুন দিল্লি এবং বেজিং-এর যোগ ইসলামাবাদের সঙ্গে।

Loading