বাংলা

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিচার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হিন্দু আধিপত্ববাদী হিংসাকে বৈধতা দিল

উত্তরপ্রদেশেরঅযোধ্যায়একটিবিখ্যাতমসজিদকেধ্বংসকরতেএবংতারজায়গায়পৌরাণিকহিন্দুদেবতাশ্রীরামেরএকটিমন্দিরগড়তেভারতেরশাসকদলভারতীয়জনতাপার্টি (বিজেপি)এবংতাদেরহিন্দুআধিপত্ববাদীমিত্ররাদশকেরপরদশকধরেযেহিংসারআশ্রয়নিয়েছে, গতশনিবারেরএকআদেশে, ভারতেরসর্বোচ্চআদালতসেইহিংসাকেন্যায্যবলেশিলমোহরদিয়েছে।

তখনকার সর্বোচ্চ বিজেপি নেতাদের আদেশে এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক কর্মীরা ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ আক্রমণ করে এবং কুঠার ও হাতুড়ি দিয়ে ওই বহু শতাব্দী-প্রাচীন কাঠামোটিকে ধ্বংস করে। ১৯৪৭-এ উপমহাদেশ মুসলিম পাকিস্তান ও প্রধানতঃ হিন্দু ভারতে ভাগ হবার পর থেকে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষরণ হয়েছিল বাবরী মসজিদ ধ্বংসের সময়ে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসায় ২০০০-এর বেশী মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যাদের বেশীর ভাগই ছিলেন দরিদ্র মুসলমান।

তাদের শনিবারের রায়ের মাধ্যমে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ বেআইনি ভাবে ধ্বংস করাকে বৈধতা দিয়েছে এবং সেই মসজিদ যে স্থানে অবস্থিত ছিল, সেখানে শ্রীরামচন্দ্রকে পুজো করার জন্য এই মন্দির নির্মাণ করার অনুমতি দিয়েছে। এবং এই বিষয় সত্যি যে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রাম মন্দির নির্মাণের তদারকি করার জন্য বিজেপি সরকারকে "আদেশ দিয়েছে"।

বলাই বাহুল্য যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তার দল বিজেপি এবং অপরাধপ্রবণ হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন আর-এস-এস, যারা বিজেপির অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় কর্মীদের জোগান দেয়, তারা আদালতের এই রায়ে উচ্ছসিত হয়েছে।

মোদি টুইট করেছেন: "এই রায় বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও ভরসা আরও বাড়িয়ে দেবে"।

এই রায় হিন্দু আধিপত্ববাদী অধিকারের দাবিকে সত্য প্রমাণ করে এবং তাকে আরও সাহসী করে তুলবে। ভন্ডামীর শীর্ষ সীমায় পৌঁছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই রায় সম্পর্কে বলেনঃ "এই রায় স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিল যে আইনের সামনে সকলে সমান"।

প্রথম থেকেই রামমন্দির নির্মাণের জন্য বিজেপি, আর.এস.এস, এবং আর.এস.এস-এর শাখা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শুরু করা প্রচারে সুচিন্তিত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্ররোচনা ছাড়াও রয়েছে ধর্মীয় অশ্লীলতা - যার উদাহরণ পাওয়া যায় এই দাবির মধ্যেই যে বাবরি মসজিদই পৌরাণিক ঈশ্বর রামচন্দ্রের জন্মস্থান। ১৯৯০-এ বাবরি মসজিদের জায়গায় হিন্দু মন্দির বানিয়ে ভারতের "হিন্দু চরিত্র"-কে, অর্থাৎ হিন্দু আধিপত্ববাদকে প্রমাণ করতে তাদের যে বিপ্লবী দাবি, তাকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিজেপি সভাপতি এল.কে.আদবানী সারা দেশে মিছিলের প্রচার চালান। আদবানীর রাম রথ যাত্রা প্রচার অভিযান উত্তর ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসার প্ররোচনা দিয়েছিল এবং এর ফলে ১৯৯০-এর অক্টোবরে বাবরি মসজিদে প্রবেশ করার এবং তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়।

দুই বছর পরে, আদবানী ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতৃবৃন্দ ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২-এ বিরাট জনসভার সংগঠিত করে তাদের প্রতি ভাষণ দেন। এই জনসভা বাবরি মসজিদের ওপর সফল আক্রমণকে লোকানোর উপায় হিসাবে কাজ করে। কিন্তু এক সরকারি কমিশন প্রমাণ পায় যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস একটি "পূর্ব-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র" এবং তাতে জড়িত ছিল বিজেপির শীর্ষ নেতারা। বিজেপি-আর.এস.এস-ভি.এইচ.পি-র কর্মীরা যখন ষোড়শ শতাব্দীর মসজিদটি ধ্বংস করে, তখন বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন উত্তর প্রদেশের সরকারের আদেশে হাজার হাজার পুলিশ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

তখন থেকেই বিজেপি এবং আর.এস.এস ভারতকে হিন্দু রাজ বা হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে রাম মন্দির বানানোর প্রচারকে ক্রমাগত একটি প্রধান পদক্ষেপ হিসাবে ব্যবহার করেছে।

 

শনিবার সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিল তা ২০১০-এ এলাহাবাদ হাই কোর্ট যে রায় প্রদান করেছিল, তাকে নস্যাৎ করে দিল। যে ২.৭৭ একর জমি নিয়ে বিবাদ, এলাহাবাদ হাই কোর্ট তাদের রায়ে সেই জমিকে তিন ভাগে ভাগ করেছিল - দুই ভাগ দিয়েছিল হিন্দু সংস্থাদের এবং তৃতীয় ভাগটি দিয়েছিল সুন্নি (মুসলিম) সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ওয়াকফস্‌-কে। সেই সময়ে ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েব সাইট এই রায়ের সঠিক মূল্যায়ন করে এলাহাবাদ আদালতের রায়কে বলেছিল "এক লজ্জাজনক বিচার যা হিন্দু আধিপত্ববাদী আদর্শ ও হিংসাকে বৈধতা প্রদান করল"। (বিষদ জানতে, পড়ুন: Indian High Court abets Hindu supremacists with Babri Masjid ruling).

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নেতৃত্বাধীন পাঁচ-সদস্যের বেঞ্চ শনিবার যে সর্বসম্মত রায় জারি করেছে তা স্পষ্টত ভাবেই হিন্দু অধিকারের দাবির জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী। সম্পূর্ণ জমিটি তাদের দেওয়া হয়নি বলে হিন্দু আধিপত্ববাদীরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

৯ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট যে রায়দান করেছে তা প্রমাণ করে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি কিভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে এবং ভারতের অভিজাত শাসক শ্রেণী সম্পূর্ণ প্রাথমিক গণতান্ত্রিক নীতিগুলিকে ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্রের দিকে গিয়ে চলেছে।

এই ঘটনার ঠিক আগেই ঘটে গেছে কাশ্মিরে মোদি সরকারের করা সাংবিধানিক অভ্যুত্থান। ৫ই আগস্ট বিজেপি সরকার ভারতের একমাত্র মুসলমান গরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মিরকে তাদের বিশেষ আধা-স্বায়ত্বশাসনের অধিকার থেকে বেআইনি ভাবে বঞ্চিত করেছে এবং ওই অঞ্চলকে সম্পূর্ণ ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। জন-বিরোধীতা হবেই, এই আশঙ্কা থেকেই নতুন দিল্লী জম্মু ও কাশ্মিরকে রাষ্ট্রীয় অবরোধের মধ্যে রেখেছে, যা ক্রমাগত চলেছে। এই অবরোধের মধ্যে রয়েছে "প্রতিরোধমূলক" গণ গ্রেপ্তার, মানুষের চলাফেরার ওপর প্রবল বিধিনিষেধ এবং অধিকাংশ সেলফোন ও ইন্টারনেটের সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বারবার এই কাজগুলিকে সোৎসাহে অনুমতি প্রদান করেছে। ভারতের বিরোধী দলগুলি সে দেশের অভিজাত কর্পোরেটের থেকে নিজেদের অবস্থান স্থির করেছে। কর্পোরেট চায় বিশ্ব মঞ্চে ভারতের মহাশক্তি হবার উচ্চাকাঙ্খাকে রূপ দিতে "জোর ব্যবস্থা" নিতে এবং ভারতের শ্রমিক ও মজুরদের শোষণ আরও বাড়াতে। এই কর্পোরেটরা কাশ্মিরের ওপর মোদির আক্রমণকে সমর্থন জুগিয়েছিল।

অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ক্ষেত্রে সব বিরোধীদের প্রতিক্রিয়াই একই রকম। কংগ্রেস পার্টি কয়েকদিন আগে পর্যন্তও সরকার গড়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় বুর্জোয়াদের পছন্দের দল ছিল। তারা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে যে ধ্বংস হওয়া বাবরী মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা সমর্থন জানাবে।

কংগ্রেস নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার স্তম্ভ হিসাবে দাবি করে। কিন্তু হিন্দু আধিপত্ববাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার ক্ষেত্রে তাদের ইতিহাস দীর্ঘ ও কুখ্যাত, যার মধ্যে রয়েছে জোর করে ১৯৪৭-এ দক্ষিণ এশিয়ার এক সাম্প্রদায়িক দেশভাগ সম্পন্ন করা। ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে যে আগে থেকে সাবধান করা হয়েছিল এবং তিনি তার পরেও তা ঘটতে দিয়েছিলেন, এমন মনে করার মতন যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যারা বিজেপির নিকটতম মিত্র ছিল, সেই শিবসেনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ভারতের দ্বিতীয় জনবহুল রাজ্য মহারাষ্ট্রে সমর্থন করার বিষয়ে ফ্যাসিবাদী শিবসেনার সঙ্গে কংগ্রেস এই মুহূর্তে আড়ালে আলোচনা চালাচ্ছে।

স্তালীনপন্থী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) বিজেপি ও হিন্দু আধিপত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই মিথ্যাকে প্রচার করে যে বিচারব্যবস্থা এবং কংগ্রেস পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধু। তারা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়দানের পক্ষে বক্তব্য পেশ করেছে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় স্পষ্টতই হিন্দু আধিপত্ববাদের অপরাধমনস্কতা ও হিংসাকে বৈধ বলে প্রমাণ করে এবং তাকে পুরস্কৃত করে। তবুও সিপিএম পলিটব্যুরোর বক্তব্য এই রায়কে কেবলমাত্র "প্রশ্নাতিত নয়" বলে অভিহিত করেছে এবং তাদের বহুদিনের অবস্থানকেই পুণরায় জানিয়েছে যে যদি "আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা না হয়" তবে অযোধ্যা বিতর্কের সমাধান কোর্টেই হওয়া উচিৎ।

সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে তাতে তারা আইনকে একটি হাস্যকর বিষয় বানিয়ে দিয়েছে। এই ফলাফলের ষড়যন্ত্র আগে থেকেই করা ছিল: হিন্দু আধিপত্ববাদী রাম মন্দির আন্দোলনে তাদের অবিসংবাদত ভাবে জয়ী ঘোষণা করে মোদি, বিজেপি সরকার এবং হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য।

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি এবং সর্ব ধর্মের সমতা সম্বন্ধে যে ভন্ডামি ভারতে রয়েছে, এই রায় তাকেই পুণরায় নিশ্চিত করল। এটি স্বীকার করেছে যে ১৯৯২-এর বাবরী মসজিদ ধ্বংস একটি অপরাধ ছিল। তেমনই ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদে লুকিয়ে রামলালার মূর্তি ঢোকানোও এক অপরাধ ছিল, এবং এরই ভিত্তিতে আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যোগসাজস করে মুসলিম পূজারিদের মসজিদে ঢুকতে দেয়নি।

কিন্তু এর কোনো কিছুই ভারতের শীর্ষ আদালতকে এক অদ্ভুত, হিন্দু আধিপত্ববাদী রায়দান থেকে বিরত করতে পারেনি। এই রায়দানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে মুসলমানরা কখনো পুরো জায়গাটির ওপর কর্তৃত্ব করেনি - এবং ঘোষণা করে যে এরাম লালা বা রামচন্দ্রের শিশু অবতারই এই বিতর্কিত জমির মালিক।

বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মতন "অপরাধের" বিষয়ে, রামলালা মন্দির স্থাপন করে বিজেপি-আর.এস.এস-এর হিন্দু আধিপত্ববাদ কায়েম করার চেষ্টায় জয় পাবার পরেও এবং মুসলমানদের অনির্ধারিত জমিতে নতুন মসজিদ বানাতে বলার পরেও সুপ্রিম কোর্ট আশা করছে ভারতের ২০ কোটি মুসলমান শান্তি বজায় রাখবে।

এইবিষয়টিবলাপ্রয়োজনযেসরকার, আদালতওপুলিশসহভারতেররাষ্ট্রীয়কর্তৃপক্ষআদবানীবাবাবরীমসজিদধ্বংসেরএবংতারজন্য১৯৯২-এরডিসেম্বরও১৯৯৩-এরজানুয়ারিতেহওয়াসাম্প্রদায়িকহিংসারতরঙ্গেরঅন্যান্যপ্রধানপ্ররোচনাপ্রদানকারীদেরওসংগঠকদেরসাজাদিতেভারতেরসরকারযেব্যর্থ, এইবিষয়েভারতেরসর্বোচ্চন্যায়ালয়সম্পূর্ণনিশ্চুপ।

"গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ" ভারতেরএমনইদশাএবং২০১৯-এদাঁড়িয়েভারতেরসর্বোচ্চআদালতেরএমনইমানসিকতা!

Loading