বাংলা

বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে দশ লক্ষ ভারতীয় ব্যাঙ্ক কর্মচারী দুই দিনের জাতীয় ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন

রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ ও বেসরকারীকরণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর  সরকারের পরিকল্পনার বিপরীতে সোমবার ও মঙ্গলবার প্রায় দশ লক্ষ পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কের কর্মীরা দুই দিনের জাতীয় ধর্মঘটে যোগ দিয়েছেন। ধর্মঘটকারী শ্রমিকরা ভারতজুড়ে বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ করেছে।

এই দুই দিনের কর্মসূচি ভারতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে শ্রেনী এবং অন্যান্য সামাজিক লড়াইয়ের ক্রমবর্ধমান ঢেউইয়ের একটি অংশ। আগামীকাল, সরকারী  বীমা সংস্থাগুলির কর্মীরা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে যোগ দেবেন। ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লির উপকণ্ঠে বিভিন্ন স্থানে শিবির স্থাপন করে হাজার হাজার কৃষক সরকারের  কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অবিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ করছেন।

ব্যাঙ্ক কর্মীদের ধর্মঘটের প্রেরণা ছিল সেই সিদ্ধান্ত, যেটি উপস্থাপিত করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামান গত ১ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে, যেখানে রয়েছে আরও দুটি সরকারী  ব্যাঙ্ককে বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত। সরকার ইতোমধ্যে  আইডিবিআই  ব্যাঙ্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন ২০১৯ সালে  এবং গত চার বছরে ১৪ টি পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্ককে সংযুক্তি করেছে। ব্যাঙ্ক কর্মীরা   বৈধভাবে আশঙ্কা করছেন যে সংযুক্তি এবং বেসরকারীকরণের ফলে ব্যাঙ্কগুলিকে আরও  লাভজনক করার লক্ষ্যে চাকরী, মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধাগুলি হ্রাস পাবে এবং কাজের চাপ বাড়বে।

২০২১ সালের ১৫ ই মার্চ সোমবার, ভারতের আহমেদাবাদে বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে ব্যাংকের কর্মীরা বিক্ষোভ করছেন (এপি ফটো / অজিত সোলঙ্কি)

শীর্ষ স্তরের ম্যানেজমেন্টাল স্টাফ ব্যতীত, স্কেল১,২ এবং তৃতীয় স্কেল থেকে সমস্ত পাবলিক ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা দুই দিনের ধর্মঘটে পুরোপুরি অংশ নিয়েছিল, নিয়মিত  ব্যাঙ্ক পরিষেবাগুলিতে প্রভাব ফেলেছিল, যেমন শাখায় চেক ছাড়, জমা এবং উত্তোলন,  এবং এটিএম পরিষেবাগুলি প্রভাবিত ছিল না । ট্রেড ইউনিয়নের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন: “ছাড়পত্রের জন্য গড়ে প্রায় ১৬,৫০০ কোটি টাকা মূল্যমানের   প্রায় ২ কোটি [২০ মিলিয়ন] চেক / আটকে রয়েছে। সরকারী কোষাগার পরিচালনা এবং সমস্ত সাধারণ ব্যাংকিং লেনদেন প্রভাবিত হয়েছে। ”

ক্রমবর্ধমান শ্রমিক শ্রেণির বিরোধিতা সম্পর্কে সরকার ও ক্ষমতাসীন শ্রেণীর মধ্যে যে ভীতি রয়েছে তা প্রতিফলিত করে অর্থমন্ত্রী সিতারমন ভুয়া দাবি করেছেন যে  বেসরকারীকরণের অধীনে “প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হবে না বা শ্রমিকদের সরানো হচ্ছে না” এবং “বেতন  বা কর্মচারীদের স্কেল বা পেনশন, সকলের যত্ন নেওয়া হবে”।

ইউনাইটেড ফোরাম অফ ব্যাঙ্ক ইউনিয়ন (ইউএফবিইউ),  হরতাল ডেকেছে সরকারী খাতের ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলির একটি ফেডারেশন, যার মধ্যে অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক কর্মচারী সমিতি (এআইবিইএ), অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (এআইবিওএ), ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (বিইএফআই) রয়েছে ), ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক  এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (আইএনবিইএফ), ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফিসার্স কংগ্রেস (আইএনবিওসি), ব্যাঙ্ক ওয়ার্কার্সের জাতীয় সংস্থা (এনওবিডাব্লু) এবং ব্যাঙ্ক অফিসারদের  জাতীয় সংস্থা (এনওবিও)।

ধর্মঘটটিতে অংশ নেওয়ার পরে, ব্যাঙ্ক কর্মীরা সুস্পষ্টভাবে সরকারের বেসরকারীকরণ পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগকারীদের পক্ষের অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের প্রস্তুতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। ডাব্লুএসডব্লিউএস চেন্নাইয়ের  ভালুভর কোট্টমে কর্মীদের সাথে কথা বলেছিল, সারা দেশে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি সমাবেশের মধ্যে একটি।

মাহা ব্যাখ্যা করেছিলেন: “আমি বেসরকারীকরণ এবং সরকারী  ব্যাংকগুলির সংযুক্তির  বিরোধিতা প্রকাশ করার জন্য ধর্মঘটে যোগদান ও প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যাংকগুলি বেসরকারী করা হলে সেখানে চাকরির সুরক্ষা এবং ব্যাঙ্ক কর্মীদের জন্য  বর্তমান সুবিধাগুলি থাকবে না, এবং বেসরকারীকরণের ফলে সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

Striking bank workers at a protest in Chennai (Credit: WSWS) চেন্নাইয়ে  প্রতিবাদ করছেন ধর্মঘটকারী ব্যাংকের কর্মীরা (ক্রেডিট: ডাব্লুএসডাব্লুএস)

 “আমি এই ব্যাঙ্কের চাকরি পাওয়ার জন্য একটি পরীক্ষা দিয়েছি কারণ আমি ভেবেছিলাম   সরকারি খাতে চাকরি নিরাপদ। আমি বরোদা ব্যাঙ্কে কাজ করি। এটি কয়েকটি অন্যান্য   ব্যাঙ্কের সাথে সংযুক্তি করা হয়েছে। আসলে, ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিও বেসরকারীকরণের   দিকে পরিচালিত করবে। আমি দেখি না আমার কাজটি নিরাপদ। আগের ধর্মঘটের মতো নয়, এই কর্মে শ্রমিকদের বেশি অংশগ্রহণ রয়েছে। ”

অন্য ব্যাংকের কর্মচারী রাও মন্তব্য করেছেন: “আমি গত আট বছর ধরে ব্যাঙ্কে কাজ  করছি। আমি ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারীকরণের বিরোধী। বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলিতে   জনগণের সঞ্চয়ের কোনও সুরক্ষা থাকবে না। বেশিরভাগ বেসরকারী ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে  যায়। এই পরিস্থিতিতে যদি সরকারী খাতের ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারী হয়ে যায়, সাধারণ  মানুষের সঞ্চয় লুণ্ঠিত হবে।

“কোনও রাজনৈতিক দলই আমাদের সংগ্রামকে সমর্থন করে না। যেমন আপনি বলেছেন, তারা সকলেই একটি অবস্থানের উপরে দাঁড়িয়েছে, পুঁজিবাদের প্রতিরক্ষায়।”

ইউএফবিইউ শ্রমিকদের তীব্র ক্ষোভের কারণে ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু   ইউনিয়নগুলি বিরোধীতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, এই আশঙ্কায় যে এটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তারা ব্যাঙ্ক কর্মীদের মধ্যে বিপজ্জনক মায়া প্রচার করছে যে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করলে এটি তার বেসরকারীকরণের নীতিগুলিকে পরিবর্তন করবে।  

আইআইবিওএর সাধারণ সম্পাদক সৌম্য দত্ত গলাবাজি করে ঘোষণা করেছেন: 'সরকার  যদি  তাদের কথা না শোনে তবে তারা  চলমান কৃষকদের আন্দোলনের  মতো আরও বড়, অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে নামবে।'

ইউনিয়নগুলি বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে বাৎসরিক ভিত্তিতে সীমিত ধর্মঘটের আয়োজন করেছে, কেবলমাত্র সরকারী শিল্পের বিরুদ্ধে সরকার তার অভিযান আরও তীব্র করতে এবং সামাজিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আরও আক্রমণ চালানোর জন্য। গত সেপ্টেম্বরে, সরকার সংসদের মাধ্যমে কৃষি খাতকে বড় ধরনের কৃষি কর্পোরেশনের আধিপত্যের অধীনে রেখে তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করেছে এবং  চুক্তি শ্রমের ব্যবহার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন শ্রম আইন করে, নিয়োগকর্তাকে তার ইচ্ছামত শ্রমিক নিয়োগের অনুমতি দেয় এবং বেশিরভাগ শ্রমিক  আন্দোলনকে অবৈধ করে তোলে।

ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলি যে ভূমিকা পালন করেছে তার সাথে রাজনৈতিক দলগুলির বড় ব্যবসা নীতিগুলির সাথে এটি সম্পর্কিত যার সাথে তারা অনুমোদিত। এই সমস্ত দলগুলি মোদী সরকার এর মতই বিনিয়োগকারীদের পক্ষে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।  

এআইবিইএ এবং এআইবিওএ উভয়ই স্টালিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) এর সাথে যুক্ত। বেইফআইয়ের সেন্ট্রাল অফ ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়নগুলির সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, যা অন্যান্য প্রধান স্টালিনবাদী দল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিএমের সাথে সম্পর্কিত। আইএনবিইএফ কংগ্রেসের সাথে অনুমোদিত, ভারতের দীর্ঘতম স্থায়ী বুর্জোয়া পার্টি।

বিগত তিন দশকে, মোদীর হিন্দু আধিপত্যবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বা কংগ্রেসের নেতৃত্বে, একইভাবে সামাজিক- উত্তেজনাপূর্ণ অর্থনৈতিক 'সংস্কার' বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৯১ সালে, কংগ্রেস সরকার ভারতকে বৈশ্বিক মূলধনের জন্য একটি সস্তা শ্রম প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করার লক্ষ্য নিয়ে এই কর্মসূচি শুরু করেছিল এবং অফিসে থাকাকালীন আগ্রাসীভাবে তা অনুসরণ করেছিল। স্ট্যালিনবাদী সিপিএম এবং সিপিআই পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরল রাজ্যে অফিসে থাকাকালীন কংগ্রেস সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় সমর্থন প্রদান করেছিল এবং নির্মমতার সাথে একই জাতীয় নীতি কার্যকর করেছিল। কেরালায় সিপিএম-নেতৃত্বাধীন প্রশাসন বর্তমানে একই কাজ করছে।

গত বছর ৮ ই জানুয়ারী এবং আবারও ২৬শে নভেম্বর,  কয়েক লক্ষ শ্রমিক  সাধারণ ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিলেন, বেসরকারীকরণ, কৃপণতা, “যখন খুশি কাজে নেওয়া ও ছাটাই করা” চুক্তি কাজ, প্রচুর কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়, হিন্দু সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার নিরলস প্রচার, প্রবল সামাজিক বৈষম্য  এবং গণতান্ত্রিক অধিকার দমনকারী মোদীর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। এই বছর তামিলনাড়ু রাজ্য পরিবহন  শ্রমিক, কেরালার রাজ্য পরিবহন শ্রমিক, বিদ্যুৎকর্মী, শিশু যত্ন কেন্দ্রের কর্মী এবং অটো শ্রমিকসহ ব্যাঙ্গালোরের টয়োটা শ্রমিকরা এবং তামিলনাড়ু রাজ্যের সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকদের দ্বারা ধর্মঘট দেখা গেছে।

শ্রমিক ও কৃষকদের লড়াই যখন বেড়েছে, তখন স্ট্যালিনবাদী দুটি দল সিপিএম এবং সিপিআই তাদের পদক্ষেপকে আরও তীব্র করছে যাতে শ্রমিক শ্রেণিকে একটি স্বাধীন  বিপ্লবী পথ অবলম্বন থেকে আটকানো যায়। তারা শ্রমিকদের এবং কৃষকদের বিক্ষোভকে  বিরোধী কংগ্রেসের অধীনস্ত করতে চাইছে, যার সাথে সিপিএম এবং সিপিআই রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ, এবং অন্যান্য ডানপন্থী বিরোধী দলসমূহ। স্ট্যালিনিস্টরা পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং আসামে পরের মাসের রাজ্য নির্বাচনের জন্য কংগ্রেসের সাথে একটি জোটে রয়েছেন।

ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণিকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে স্টালিনবাদীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে এবং এবং পুঁজিবাদী শাসনকে উৎখাত করার লড়াইয়ের বিপ্লবী কৌশল অবলম্বন করে, সেই সংগ্রামে কৃষক এবং অন্যান্য নিপীড়িত জনগণকে  নেতৃত্ব দিতে হবে। উদ্দেশ্যটি হবে আন্তর্জাতিকভাবে সমাজতন্ত্রের জন্য একটি বিস্তৃত সংগ্রামের অংশ হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের একটি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা। জরুরীভাবে যা প্রয়োজন তা হ'ল বিশ্ব ট্রটস্কিবাদী আন্দোলন চতুর্থ, আন্তর্জাতিকের আন্তর্জাতি্ক কমিটির (ICFI)-এর ভারতীয় শাখা গঠণ করা।

Loading