বাংলা

বাংলাদেশি পুলিশ ছয়জন নির্মাণ শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করেছে

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামের (চট্টগ্রাম,) বাঁশখালীতে কয়লা চালিত এসএস পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পে বাংলাদেশি পুলিশ ছয় নির্মাণ শ্রমিককে গুলিকরে হত্যা করেছে। ১৭ই এপ্রিল প্রায় ২,০০০ শ্রমিক নিয়মিত মজুরি প্রদানের জন্য এবং কঠোর কাজের শর্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল সেই সময় পুলিশি গুলি চালনার ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (সূত্র: উইকিপিডিয়া)

ঘটনাস্থলেই চার শ্রমিক মারা যান এবং কয়েকডজন আহত প্রতিবাদকারীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন পরে একজন শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন এবং অন্যজন ২১শে এপ্রিল। মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, প্রায় ২০ জন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। তবে এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ২০ এপ্রিল জানিয়েছে যে পুলিশি হামলায় ৫০ জনেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়েছে।

এই হিংসতার নির্বিচার চরিত্রটি পুলিশি বিবৃতিতে প্রকাশিত হয়েছে যেটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ আধিকারিকরা '৩৩২ রাউন্ড গোলাবারুদ — ২০২ রাউন্ড রাবার বুলেট, শটগান থেকে ৬৮ রাউন্ড সীসা বল গুলি, চাইনিজ রাইফেল থেকে ৬২ রাউন্ড গুলি' গুলি ছোড়ে। ”

১৭ই এপ্রিল সকালে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভটি নয়টি মূল দাবিকে নিয়ে হয়েছিল। এর মধ্যে রমজান মাসে দুই ঘন্টার অতিরিক্ত ছুটি, প্রতি শুক্রবার কাজের সময় পাঁচ ঘন্টা হ্রাস, যা ইতিমধ্যে একটি বাংলাদেশী জাতীয় ছুটি, বেতন বৃদ্ধি, সময়মতো বেতন প্রদান এবং অন্যান্য বকেয়া সুবিধাগুলি সম্পূর্ণ বিতরণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম ও কঠোর জীবনযাপন অবসানেরও দাবি জানিয়েছিল।

এক নির্মাণ শ্রমিক মোঃ রফিক, ২১ শে এপ্রিল ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন যে প্রায় প্রতিটি শ্রমিক স্বাস্থ্যহীন নিম্নমানের জল সরবরাহ ও টয়লেট সহ উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে বসবাস করার মুখোমুখি হন।

পুলিশের আক্রমণের পরে নির্মাণ প্রকল্পটি পরিদর্শন করা ডেইলি স্টার এর সাংবাদিক ভয়াবহ অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন: “আবাসন অস্বাস্থ্যকর এবং ছত্রভঙ্গ এবং শ্রমিকরা যে টয়লেটগুলি ব্যবহার করত তা এতটা অস্বাস্থ্যকর যে কেউ এটা ব্যবহার করবে বলে আশা করা শক্ত। তাদের আবাসনের সংলগ্ন ড্রেনটি মানব বর্জ্য দিয়ে উপচে পড়া এবং এক দুর্গন্ধযুক্ত নির্গমন করতে দেখা গেছে। '

বাংলাদেশী নির্মাণ সংস্থা, এস আলম গ্রুপ চীনের শানডং তেজুন ইলেকট্রিক পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য ২.৪ বিলিয়ন ডলার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এই প্রকল্পটিতে প্রায় ৩,৫০০ বাংলাদেশী এবং ৮৫৩ জন চীনা শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। স্থানীয় বেশিরভাগ শ্রমিককে বিভিন্ন সাবকন্ট্রাক্টিং সংস্থার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এই হত্যাকাণ্ড শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রতিক্রিয়াটিকে আরও আলোকপাত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের সংগ্রাম এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে পুলিশকে ছার দিয়েছেন।

ডেইলি স্টারের একটি সম্পাদকীয় লিখাছে: “আজকাল লাঠি বা কাণ্ডের চেয়ে পুলিশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র বেশি দেখা যায়। এবং পুলিশ এই পরিস্থিতিতে গুলি চালাতে খুব প্রস্তুত হয়ে উঠছে। ' পাঁচ বছর আগে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে পুলিশ চার জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছিল এই প্রকল্পের জন্য তাদের জমি জবর দখল করার প্রতিবাদ করার জন্য।

নির্মান শ্রমিকদের উপর খুনি হামলার ঘটনায় ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ বিক্ষোভের গল্পটি উত্থাপন করতে শুরু করে।

ডেইলি স্টারের সাংবাদিক দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মিথ্যা দাবি করেছেন যে প্রতিবাদকারীরা, “এই প্রকল্পে চীনা শ্রমিকদের উপর হামলা করার চেষ্টা করেছিল। এমনকি তারা তাদের সহকর্মী ও পুলিশ কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছিল এবং বেশ কয়েকটি প্রকল্পের সম্পত্তি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ” একটি পুলিশ মামলার বিবৃতিতে এমনকি দাবি করা হয়েছে যে শ্রমিকরা 'পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল।'

এই মনগড়া দাবির বিপরীতে, একজন তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে সংঘর্ষের সময় কোনও পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করা হয়নি এবং কোনও চীনা শ্রমিকের ক্ষতি হয়নি।

নির্মাণ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দুটি বোগাস মামলা দায়ের করা হয়েছে একটি বাঁশখালী পুলিশ এবং অন্যটি প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়কারী দ্বারা। প্রথম মামলায় দাবি করা হয়েছে যে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজারের মত অজ্ঞাতপরিচয় মানুষ পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। অন্য মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে ২২ জন নামযুক্ত ব্যক্তি এবং ১,০৫০ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে।

শ্রম নিয়োগকারী সংস্থাগুলি জানিয়েছে যে পুলিশি হামলা এত মারাত্মক ছিল যে শ্রমিকরা গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কায় পদত্যাগ করছে। বেলাল হোসেন নামে একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রি যিনি তাঁর ডান পা’তে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তিনি নতুন যুগকে বলেছেন যে তিনি আর কখনও সেখানে কাজ করবেন না।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে এবং পুলিশ এই তদন্তের জন্য একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিগুলি যা ঘটেছিল তা ঢাকতে এবং হত্যাকারী পুলিশি হামলার জন্য দায়ীদের সুরক্ষিত করতে ব্যবহৃত হবে।

নৃশংস আক্রমণ নিয়ে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে ট্রেড ইউনিয়ন ও স্ট্যালিনিস্ট নিয়ন্ত্রিত সংস্থাসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই ক্ষোভ ছিন্ন করতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।

১৭ এপ্রিল, সমাজতান্ত্রিক স্টুডেন্টস ফ্রন্ট এই হামলার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। দু'দিন পরে, স্ট্যালিনিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ (সিপিবি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী পুলিশকে গ্রেপ্তার এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলির পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের দাবিতে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের বাইরে সমাবেশ করেছে।

পোশাক কারখানার মালিকদের সহযোগিতায় শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এবং গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার পরিষদ, গত বুধবার বিচারিক তদন্তের দাবিতে পৃথক বিক্ষোভ করেছে।

রবিবার সিপিবিসহ আট তথাকথিত বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট যশোরে সমাবেশ করেছে। জোটের সমন্বয়ক রশিদ ফিরোজ সরকারের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান।

মানবাধিকারের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র সরকারকে এই গুলিচালনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নির্মাণ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ফ্রেমআপ মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।

এই বিক্ষোভ সত্ত্বেও, বাংলাদেশী ইউনিয়ন এবং স্টালিনবাদী দলগুলি হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং তাদের অধিকারের জন্য শ্রমিকদের সংগ্রামকে দমন করেছে। স্টালিনবাদী ওয়ার্কার্স পার্টি বর্তমানে হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শাসনের অংশীদার।

স্বল্প মজুরি ও ক্রমবর্ধমান কোভিড -১৯ সংক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে হাসিনা সরকার পাট ও পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের দ্বারা বিক্ষোভের একটি ঢেউয়ের মুখোমুখি হচ্ছে।

গত জুলাইয়ে, রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ টি পাট কারখানা বন্ধ হওয়ার পরে এবং ৫০,০০০ শ্রমিক কাজ হারানোর পরে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মধ্যে বাংলাদেশ আদালত দুইজন পাটকল ইউনিয়ন কর্মীকে জেল দিয়েছিল।

ফেব্রুয়ারিতে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে কয়েকশ পরিবারের বর্জ্য সংগ্রহের কর্মীরা হুমকীযুক্ত কাজের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন।১৭ই এপ্রিল, প্রায় ৫০০ রিকশা চালক বারিশাল শহরে খাদ্য রেশনের দাবিতে মিছিল করে, ৫৯মার্কিন ডলারের ন্যায় মাসিক নগদ প্রদান এবং করোনভাইরাস আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিত্সা করার জন্য।

ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ বর্তমানে ১৪ ই এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল লকডাউনে রয়েছে। দেশে এখন ৭,৩০,০০০ বেশী কেস এবং ১০,৬০০ জন মারা গেছে।

বিদ্যুৎ ও অংশীদারিত্ব গবেষণা কেন্দ্র এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, মহামারী সম্পর্কে বাংলাদেশী সরকারের প্রতিক্রিয়ার ফলে দেশের 'দুর্বল গরীব নয় 'এমণ ১৪. ৭ শতাংশ বা ২৪.৫ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে গেছে।

গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন যে মহামারী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্রতম পরিবারগুলির মধ্যে তার সরকার কেবল ৩.৬ মিলিয়নকে ১.২৪ ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে।

Loading