বাংলা
Perspective

যিনি গুজরাটের কসাই বাইডেন সেই মোদীর প্রশংসা করেছেন, ভারতের গণমৃত্যুর কোভিড নীতির জন্য

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের 'কোয়াড সামিট' এর অধিবেশন চলাকালীন একটি রুদ্ধদ্বার মত বিনিময় হয়েছিল।

প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই) দ্বারা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাইডেন কোভিড মহামারীকে 'সফলভাবে' পরিচালনা করার জন্য মোদীর 'প্রশংসা' করেছেন এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীনের 'ব্যর্থতার' সাথে ভারতের সাফল্যের তুলনা করেছেন, একজন সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তার মতে। '

পিটিআই যোগ করেছে যে 'বাইডেন বলেছেন যে মোদির সাফল্য বিশ্বকে দেখিয়েছে যে গণতন্ত্রগুলি সরবরাহ করতে পারে, এবং চীন এবং রাশিয়ার মতো 'স্বৈরাচারীরা' দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বকে আরও ভালভাবে পরিচালনা করতে পারে এমন কল্প কাহীনিকে উড়িয়ে দিয়েছে...'

বামদিক থেকে: অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা টোকিওতে, কান্তেই প্রাসাদে কোয়াড নেতাদের সম্মেলনে। মঙ্গলবার, ২৪শে মে, ২০২২, (এপি ছবি/ইভান ভুচি)

তিনি কোন পদ্ধতি দ্বারা ভারতের 'সাফল্য' পরিমাপ করছিলেন অথবা সেই বিষয়ে, এর 'গণতান্ত্রিক' চরিত্র সমন্ধে বাইডেন কিছু বলেননি। আমাদের ঘটনাগুলি পর্যালোচনা করা যাক.

ভারত সরকারীভাবে ৪,৩২,০০,০০০ মামলার মধ্যে COVID-19 এর কারণে ৫,২৫,০০০-এর বেশি মৃত্যুর রির্পোট করেছে। এই পরিসংখ্যানগুলি – নিজেই একটি বিস্ময়কর জীবনহানির - সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত, শুধু ভারত সরকার ব্যতীত, যা অবশ্যই বিশালভাবে কম করে দেখানো।

এই মাসের শুরুতে প্রকাশিত 'অতিরিক্ত মৃত্যু' সম্পর্কিত তার প্রতিবেদনে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমান করেছে যে প্রকৃত সংখ্যা ৩.৩ মিলিয়ন থেকে ৬.৫ মিলিয়নের মধ্যে, ২০২০ এবং ২০২১ সালে ভারতে ৪.৭ মিলিয়ন মানুষের মারা যাওয়ার গড় অনুমান সহ। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী মোট আনুমানিক অতিরিক্ত মৃত্যুর মধ্যে ১৪.৯ মিলিয়ন, যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারতে।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের একটি পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছিল যে ২০২০ এবং ২০২১ সালে ভারতের মোট অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ লক্ষ থেকেও বেশি।

এইভাবে, বাইডেনের মতে, মোদি সরকারের 'সাফল্য' হল গ্রহের যে কোনও দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি COVID-19 মৃত্যুর তত্ত্বাবধান করা।

এই বিষয়ে ভারতের পারফরম্যান্স উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চতর ছিল, নিখুঁতভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায়, যা তার মাত্র ১.১৩ মিলিয়ন নাগরিককে হত্যা করতে 'সফল' হয়েছিল, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে, ল্যানসেটের মতে। তবে, জনসংখ্যার শতাংশ হিসাবে, মৃত্যুর হার প্রায় সমান।

বাইডেন এবং তিনি যে আর্থিক ধনী অভিজাতদের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের জন্য আসল সাফল্য হল, এটাই কি যে ভারত মহামারী জুড়ে উত্পাদন চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল, মার্কিন গাড়ী উত্পাদন সহ আন্তঃজাতিক কর্পোরেশনগুলির প্রধান উত্পাদন ক্ষেত্রগুলিতে কাজ চালিয়ে যাওয়া। মোদীর ঘোষণার পর যে তিনি 'লকডাউন থেকে দেশকে বাঁচাবেন' তার পরেও জুন মাস সহ ভারতে অটোওয়ার্কদের দ্বারা ধারাবাহিক ধর্মঘট হয়েছে।

মোদির নীতির ফলস্বরূপ, ভাইরাসটিকে বাধা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া হয়েছিল এবং সারা দেশে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগুন জ্বালানো হয়েছিল।

পরিবারের সদস্যরা ভারতের শ্রীনগরের একটি শ্মশানে COVID-19-এ মারা যাওয়া একজন ব্যক্তির জ্বলন্ত চিতার পাশে প্রার্থনা করছেন। 25 মে, 2021, (এপি ছবি/দার ইয়াসিন)

এবং চীনের 'ব্যর্থতা' কি? ল্যানসেট অনুমান করে যে ২০২০ এবং ২০২১ সালে মোট অতিরিক্ত মৃত্যুর পরিমাণ ছিল ১৭,৯০০, যখন WHO উপসংহারে পৌঁছেছে যে মহামারীর দুই বছরে দেশে ৬৮,০০০ কম লোক মারা গেছে যা জাতীয় গড়ের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত ছিল।

মোদির প্রতি তার মন্তব্যে বাইডেন যেমন উল্লেখ করেছেন, চীন (১.৪ বিলিয়ন) এবং ভারতের (১.৩৮ বিলিয়ন) জনসংখ্যা আকারে তুলনীয়। ল্যানসেটের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ভারতের মৃতের সংখ্যা অবশ্য চীনের চেয়ে ২২৩ গুণ বেশি। অনেক কম জনসংখ্যা (৩২৯ মিলিয়ন) সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৬৩ গুণ বেশি ছিল।

গত দুই বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে চীনে মহামারীকে আটকে রাখা, জীবন বাঁচানো এবং তার জনসংখ্যার জন্য অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার ক্ষমতা তার একটি জিরো-কোভিড নীতি বাস্তবায়নের কারণে হয়েছে। এই নীতির ধারাবাহিকতা, আর্থিক পুঁজির প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে, সাংহাইতে ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের সাম্প্রতিকতম প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছে, শহরটি ১লা জুন আংশিকভাবে খোলার কারণে।

আসুন এখন নরেন্দ্র মোদী এবং তার ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকারের 'গণতন্ত্রের' দিকে ফিরে যাই। এটি একটি সত্য, এখন পুঁজিবাদী মিডিয়াতে সর্বজনীনভাবে যা উপেক্ষা করা হয়, নরেন্দ্র মোদি ২০০২ সালে উত্তর-পূর্ব রাজ্যে গুজরাটের একটি মুসলিম বিরোধী গণহত্যার তদারকি করে রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, যখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

হিটলার ও মুসোলিনির অনুরাগীদের দ্বারা ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), একটি হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কাজ করার পর মোদি ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এই পদে বসেন। বিজেপিতে, যেখানে মোদিকে ১৯৮৫ সালে স্থাপন করা হয়েছিল, যা কার্যকরভাবে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা।

গুজরাট গণহত্যা ছিল ১৯৪৭ সালের বিভক্তির পর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। এটি ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনের বগিতে অগ্নিকাণ্ডের পর শুরু হয়েছিল, যার জন্য মোদি কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছিলেন এবং ভারতে মুসলিম 'সন্ত্রাসী' দের। এরপর তিনি গুজরাটে ধর্মঘটের ডাক দেন, যা গণহত্যাকে আড়াল করতে ব্যবহৃত হয়।

মোদির পুলিশ যেমন পাশে ছিল, হিন্দু উগ্রপন্থীরা, আগে থেকে প্রস্তুত করা মুসলমানদের নাম ও ঠিকানার তালিকা ব্যবহার করে, ধর্ষণ ও হত্যার প্রচারে লিপ্ত হয়েছিল যার ফলে ২,০০০ জনের মতো মৃত্যু হয়েছিল, সাথে পাইকারি হারে অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংসযজ্ঞর কারণে ১,০০,০০০ গৃহহীন হয়েছিল।

র্কনর্সানড সিটিজেন ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, “একটি শীতল কৌশল, ইতিপূর্বে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অনুপস্থিত কিন্তু এবার প্রচুর সংখ্যক মামলায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, এটি ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে প্রমাণ ধ্বংস করা। কয়েকটি ব্যতীত, যৌন হিংসতার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, শিকার নারীদের বিবস্ত্র করে নগ্ন করে প্যারেড করা হয়েছিল, তারপরে গণধর্ষণ করা হয়েছিল এবং তারপরে তাদের এমণভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল যাতে কোন ভাবেই সনাক্ত করা সম্ভব নয়।”

২০১৩ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে যে, গণহত্যার পরে, মোদি সরকার 'দায়মুক্তির পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে দাঙ্গার অপরাধীরা এবং যারা হিংসতায় অংশ নিয়েছিল তারা মনে করে যে তারা সমাজকর্মী ও সাক্ষীদের ন্যায়বিচার পাবার চেষ্টা করাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য হুমকি দিতে পারে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না ।”

ভারতীয় 'গণতন্ত্রের' জন্য এত কিছু... প্রকৃতপক্ষে, নৃশংসতায় মোদির প্রত্যক্ষ ভূমিকা এতটাই মারাত্মক ছিল যে ২০০৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনের অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য তার ভিসা প্রত্যাখ্যান করে, যা ১৯৯৮ সালের আইন যাতে 'ধর্মীয় স্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘনের' জন্য দায়ী বিদেশী কর্মকর্তাদের নিষিদ্ধ করে।

মার্কিন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ২০১৪ সালে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, যখন মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। আমেরিকান শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে, গণহত্যায় তার অ-সুবিধাজনক ভূমিকাকে একপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ওবামা প্রশাসনের দ্বারা মোদীকে হাত খুলে স্বাগত জানানো হয়েছিল। গত আট বছর ধরে, মোদি ভারতীয় কর্পোরেট অভিজাতদের নীতি প্রয়োগ করেছেন, ঠিক তেমনি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের একটি প্রধান ভূ-কৌশলগত মিত্র হিসেবে কাজ করেছেন, বিশেষ করে চীনের সাথে তার দ্বন্দ্বে।

শেষেরটি মোদীর সাথে বাইডেনের আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দু ছিল এবং পুরো 'চতুর্মুখী সম্মেলন' (Quad Summit)। এশিয়ায় তার যুদ্ধ প্রস্তুতির অংশ হিসাবে, বাইডেন প্রশাসন চীনে 'গণহত্যার' কথা বলে, যখন এটি গুজরাটের ফ্যাসিবাদী কসাইকে প্রচার করে। একই সময়ে, যেমন আমেরিকান কর্পোরেট এবং আর্থিক অভিজাতরা অবিরাম গণ সংক্রমণ এবং মৃত্যুর একটি COVID নীতির দাবি করে, এটি একটি মডেল হিসাবে ভারতের 'সফলতা'কে স্বাগত জানায়।

শেষ পর্যন্ত, মোদির প্রতি বাইডেনের মন্তব্য খোদ আমেরিকান শাসক শ্রেণীর নিজেদেরই সবকিছুর স্ব-নিন্দা হিসাবে পরিবেশন করে যা ভন্ড, অপরাধী এবং নরঘাতক।

Loading