বাংলা
Perspective

মার্কিন-ন্যাটো এবং রাশিয়া পারমাণবিক হুমকি বাড়িয়ে চলেছে

ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ কর!

কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময়, ১৯৬২ সালের অক্টোবরের পর, পৃথিবী আজকের মতো পারমাণবিক যুদ্ধের এত কাছাকাছি চলে আসেনি।

স্ট্যালিনবাদী নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভকে মহিমান্বিত করার প্রয়োজন নেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির কথা ছেড়েই দিন, ওই সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া এবং আজকের বিশ্বকে যা আঁকড়ে ধরতে চাইছে তার মধ্যে গভীর পার্থক্য রয়েছে।

কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস, এর উপর লেখা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই নিউক্লিয়ার ফোলি, ইতিহাসবিদ সের্হি প্লোখি লিখেছেন যে, উভয় পক্ষের প্রচুর ভুল গণনা এবং ভুল ধারণা সত্ত্বেও, “সঙ্কটটি একটি গুলি যুদ্ধে পরিণত হয়নি কারণ কেনেডি এবং ক্রুশ্চেভ উভয়েই পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় পেয়েছিলেন এবং তাদের ব্যবহার করার চিন্তাতেও ভয় ছিল।'

প্লোখি যোগ করেছেন যে কেনেডি এবং ক্রুশ্চেভ 'এত নিপুণভাবে নিজেদেরই তৈরি করা ফাঁদে তাঁরা পা দেননি কারণ তারা বিশ্বাস করেননি যে তাঁরা পারমাণবিক যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন, না তারা এই ধরনের বিজয়ের জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রতি দুই নেতার আরও অশ্বারোহী মনোভাব থাকলে কিউবার সংকটের ফলাফল কী হতে পারতো তা কল্পনা করাও কঠিন।”

একটি নতুন বৈশ্বিক পারমাণবিক সংকটের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র/ন্যাটো এবং রাশিয়া এই ফলাফল কী হবে তা প্রদর্শনের লক্ষ্যে একটি পদ্ধতিতে এগিয়ে চলেছে বলে মনে হচ্ছে।

তিনি তার পশ্চিমা 'অংশীদারদের' আলোচনার জন্য বাধ্য করতে পারেন এমন নির্বোধ এবং মরিয়া অনুমান নিয়ে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পরে, রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে তার দেউলিয়া এবং প্রতিক্রিয়াশীল কৌশলের বিস্ময়কর ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছেন। রাশিয়ান সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে বেশ কয়েকটি পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খারকিভের পরাজয় এবং পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সেই অঞ্চলে আরও অগ্রগতি করেছে যাকে রাশিয়া এখন নিজেদের বলে দাবি করছে।

রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা একটি যুদ্ধে প্ররোচিত হয়েছিল যার জন্য এটি অপ্রস্তুত ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কর্মসূচিকে অবমূল্যায়ন করেছিল। অভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং রাশিয়ান অভিজাতদের মধ্যে দোষারোপের মুখোমুখি হয়ে, পুতিন সরকার এর প্রতিক্রিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার দ্ব্যর্থহীন হুমকি দিচ্ছে।

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো, তাদের ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলির অনুসরণে তাদের সুবিধার পক্ষে চাপ দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তারা বিবৃতি দিচ্ছে যে তাদের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির 'ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করা' যাবে না।

আমেরিকান সংবাদপত্রে এবং টেলিভিশন প্রোগ্রামে, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর, শিরোনাম, 'পুতিনের হুমকি ওয়াশিংটনে ক্রমবর্ধমান শঙ্কা জাগিয়েছে,' রবিবার লিখেছে: 'ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি তৈরি করছেন যদি রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির ভি পুতিন ব্যর্থতার জন্য কৌশলগতভাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন ইউক্রেনে রাশিয়ান সৈন্যদের হারানোর সংখ্যাকে ঢাকতে... অনেক কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়েছেন যে রাশিয়া যদি ইউক্রেনের মাটিতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটায়, তবে বিকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ... এক ধরণের সামরিক প্রতিক্রিয়া।

রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করবে, এবিসির 'ফেস দ্য নেশন' এতে জিজ্ঞাসা করা হলে, সিআইএর প্রাক্তন পরিচালক ডেভিড পেট্রাউস উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমরা একটি ন্যাটোর নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাব, একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যা প্রতিটি রাশিয়ান প্রচলিত শক্তিকে বের করে আনবে যা আমরা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ক্রিমিয়াতে এবং কৃষ্ণ সাগরের প্রতিটি জাহাজকে দেখতে এবং সনাক্ত করতে পারি।'

জেনারেল মনে করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো কোন বাধা ছাড়াই রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে। কেউ কি বিশ্বাস করবে যে এই ধরনের পদক্ষেপ লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং শিকাগোর জনসংখ্যাকে পারমাণবিক ধ্বংসের ঝুঁকিতে ফেলবে না?

বেপরোয়াতার মাত্রাটি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধে নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া এক ইউরোপীয় কর্মকর্তার দ্বারা সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃততে করা হয়েছে, যার শিরোনাম 'রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিকরণ বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে 'দুই বা তিন ধাপ দূরে' রেখেছে': 'কেউ জানে না পুতিন কী সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু সে পুরোপুরি এক কোণে, সে পাগল… এবং তার বেড়িয়ে আসার অন্য কোন উপায় নেই। তাঁর একমাত্র উপায় হল সম্পূর্ণ জয় বা সম্পূর্ণ পরাজয় এবং আমরা শেষেরটার জন্য কাজ করছি। আমাদের জয়ের জন্য ইউক্রেন দরকার এবং তাই আমরা ইউক্রেনকে জয়ী করতে সাহায্য করে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে কাজ করছি।”

অন্য কথায়, ফলাফল যাই হোক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো শক্তিগুলি এমন একটি পথ অনুসরণ করতে বদ্ধপরিকর যা রাশিয়াকে 'সম্পূর্ণ পরাজয়ের' দিকে নিয়ে যায়। 'সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি' প্রতিরোধ করা থেকে দূরে, এই বিবৃতিগুলি ফলাফলের দিকে নিয়ে যায় সেই আগুনে ইন্ধন দিচ্ছে৷ অতল গহ্বরের ধারে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবস্থান হল: 'সম্পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ।'

তদুপরি, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো শক্তিগুলি এখন পুতিনের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, তবে এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারই করেনি, এটি এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সামরিক পরাজয় এড়াতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার বিষয়ে আলোচনা করেছে। .

১৯৫০ সালে, জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার কোরিয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে আসা চীনা সৈন্যদের বিরুদ্ধে ৩০টি পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের অনুমোদন চেয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে, ফ্রান্স মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের কাছে ডিয়েন বিয়েন ফু-তে ঘিরে রাখা তাঁদের সৈন্যদের বাঁচাতে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করে। ১৯৬২ সালে, কেনেডি নিজেই কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সময় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে, ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলিতে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে ইসরাইল মিশরের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার কাছাকাছি এসেছিল।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, সমস্ত আলোচনাই পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নিয়ে, যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এমন কোনও পরামর্শ নেই।

হতাশা এবং বেপরোয়া মেজাজ হয়তো বর্ণনা করা যেতে পারে যা ওয়াশিংটন এবং মস্কোকে আঁকড়ে ধরেছে, কিন্তু তাদের উত্স নয়। এই আচরণের একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে হবে।

পুতিন শাসনের হতাশা এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয় যে এটি ইউএসএসআর-এর বিলুপ্তির পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে, এটি একটি ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা যা পরবর্তী সমস্ত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়কে গতিশীল করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিলুপ্ত করার সময়, স্টালিনবাদী আমলাতন্ত্র মার্কস এবং লেনিন দ্বারা বিশ্লেষণ করা ইতিহাসের মৌলিক আইনগুলিকে একটি মিথ বলে বিশ্বাস করার জন্য নিজেকে প্রতারিত করেছিল। পরিবর্তে, ইউএসএসআর-এর পতনের ত্রিশ বছর পর, রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দ্বারা একটি যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে যার লক্ষ্য এটিকে ভেঙে ফেলা এবং এটিকে একটি উপনিবেশে পরিণত করা।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি, সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দীর্ঘস্থায়ী উদ্দেশ্য অনুসরণ করছে যাতে করে যে কোনওভাবে যুদ্ধের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটকে কাটিয়ে উঠতে পারে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া এবং সিরিয়াতে আগ্রাসনের দ্বারা সৃষ্ট হওয়া বিপর্যয় সত্ত্বেও, আমেরিকান শাসক শ্রেণী বিশ্বাস করে যে যুদ্ধের মাধ্যমে এটি কোনওভাবে শ্রমিক-শ্রেণীর বিরোধিতার বৃদ্ধিকে আটকাতে পারে যা তাদের পীড়িত করছে।

এই সবের মধ্যে, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতিগুলির প্রভাব সম্পর্কে কোনও খোলামেলা বক্তব্য নেই। তারা এমন একটি ঘটনার প্ররোচনার বিষয়ে কথা বলছে যা কয়েক লক্ষ, এমনকি কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করতে পারে।

কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের প্রতিক্রিয়া এবং আজকের পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কী? শেষ পর্যন্ত, কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট যে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেনি তার জন্য রাজনৈতিক সময়ের চরিত্রকে দায়ী করা যেতে পারে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদী আস্ফালনের যুগ অতিক্রম করছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশ্বের মোট ভূমির এক-ষষ্ঠাংশকে বেষ্টন করে ছিল, যা মরিয়া এবং বেষ্টিত রুশ রাষ্ট্রের চেয়ে অপরিমেয় শক্তিশালী অবস্থানে ছিল।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সৃষ্ট সংকটে পুতিনের উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বিদেশাতঙ্ক কোনো বিকল্প প্রস্তাব করে না। পুতিন, একটি পরজীবী রাশিয়ান অভিজাতদের পক্ষে কথা বলে, রাশিয়ান শ্রমিক শ্রেণীকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের চেয়েও বেশি ভয় পান। ইউএসএসআর বিলুপ্তির ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ের প্রতি তার প্রতিক্রিয়া জারবাদী রাশিয়ার মধ্যযুগীয় অস্পষ্টতাকে স্ট্যালিনবাদের প্রতিবিপ্লবী ঐতিহ্যের সাথে মিশ্রিত করে।

আমেরিকান বা রাশিয়ান অভিজাতদের 'যৌক্তিকতার' উপর কোন বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। মহামারীটি ইতিমধ্যেই মানব জীবনের প্রতি তাঁদের সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রকাশ করেছে, উভইয়েই রাশিয়ান অভিজাতরা, যা রাশিয়ায় ৪,০০,০০০ মানুষের মৃত্যু স্বীকার করেছে এবং আমেরিকান শাসক শ্রেণী, যা এমন একটি নীতি বাস্তবায়ন করেছে যার ফলে দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

যা প্রয়োজন তা হল শ্রমিক শ্রেণীর একটি গণযুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা, তার পিছনে জনসংখ্যার বিস্তৃত অংশ এবং যুবকদের একত্রিত করা।

শ্রমিকশ্রেণীকে এই প্রতিক্রিয়াশীল যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার এই সংগ্রামকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। সর্বোপরি, একটি নতুন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে, সব ধরনের জাতীয়তাবাদ এবং বিদেশাতঙ্ক প্রত্যাখ্যান করে প্রতিটি দেশে শ্রমিকদের ঐক্যের জন্য লড়াই করতে হবে।

Loading