বাংলা

বাংলাদেশ সরকার নতুন "অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাকে" ধর্মঘট বিরোধী আইন হিসাবে উত্থাপন করেছে

৬ই এপ্রিল, বাংলাদেশ সরকার একটি সংশোধিত অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল উত্থাপন করেছে, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনযন্ত্রকে যে কোনও ক্ষেত্রকে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ঘোষণা করার এবং সমস্ত শিল্প আন্দোলনকে বেআইনি করার অনুমতি দেয়। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার অবস্থার অবনতি নিয়ে শ্রমিক এবং দরিদ্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ বেড়ে চলার কারণে এই দমনমূলক ব্যবস্থা উথথাপন করা হয়েছে।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থকরা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে বাংলাদেশ, ঢাকায় ১০ই ডিসেম্বর, ২০২২-এ সমাবেশ করে। [AP Photo/Mahmud Hossain Opu]

বিলটি একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে যারা ৩০ দিনের মধ্যে প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলির সাথে রিপোর্টটিকে জমা দেবে। যদি এটি পাস হয়, নতুন আইনটি সরকারকে যে কোনও পরিষেবাকে 'অত্যাবশ্যকীয়' ঘোষণা করার অনুমতি দেবে যাকেই এটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করবে, ধর্মঘট নিষিদ্ধ করবে এবং 'অবৈধ ধর্মঘটে' জড়িত যে কাউকে ছয় মাসের জেল এবং ৫০,০০০ টাকা ($470) জরিমানা আরোপ করবে।

বিলটি ইতিমধ্যে বিদ্যমান অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইনের একটি সম্প্রসারণ এবং সরকারের স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রসারিত করার আরেকটি পদক্ষেপ। ২০১৮ সালে, হাসিনা সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধা দেয় এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর নেতাদের জেলে ভরার জন্য প্রতিবাদগুলিকে দমন করতে ব্যবহার করে।

বর্তমান অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইন ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ-সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, ই-কমার্স, ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল পরিষেবাগুলির পাশাপাশি রেলপথে এবং জলপথ, রাস্তা এবং আকাশ পথে সমস্ত ধরণের পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে শ্রমিকদের ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছে।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, নতুন বিলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; বন্দর বা বন্দর-সম্পর্কিত পরিষেবা; এবং যে কোনো সশস্ত্র বাহিনী-সম্পর্কিত পরিষেবা এবং ব্যবস্থা। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রয়েছে সরকারি মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা, জল সরবরাহ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা, যেমন হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ডিসপেনসারি।

অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইনের সম্প্রসারণ বাংলাদেশী শাসক শ্রেণীর উদ্বেগের দ্বারা চালিত হয়েছে অবনতিশীল সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক-শ্রেণির সংগ্রামের বিস্ফোরণ সম্পর্কে যা চলমান COVID-19 মহামারী এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন-ন্যাটো যুদ্ধের কারণে আরও খারাপ হয়েছে।

গত আগস্টে, অভূতপূর্ব জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক, ছাত্র এবং দরিদ্রদের দ্বারা দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়।

জানুয়ারিতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) হাসিনা সরকারকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, এই শর্তসাপেক্ষে যে এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোরভাবে খরচা কমানো বাস্তবায়ন করবে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর খবর অনুসারে, এর মধ্যে রয়েছে 'জ্বালানির দামের গতিশীল সমন্বয়-যার অর্থ হল তেলের দাম বৃদ্ধি করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অভ্যন্তরীণ খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করার জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপক সংস্থাগুলি স্থাপন করা, এবং বিনিময় হার’কে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া – এটির অর্থ হল বিনিময় হার বাজারের শক্তি সাপেক্ষ।'

আইএমএফ ঋণ অনুমোদন করার আগেই, সরকার সরকারি ভর্তুকি কমানোর জন্য ব্যাংকের দাবি মেনে গ্যাস ও বিদ্যুতের শুল্ক বাড়িয়েছে।

১০ই ডিসেম্বর, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি বৃদ্ধি এবং হিংস পুলিশি হামলার জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ডাকা বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।

৫ই ফেব্রুয়ারী, ঢাকার গার্মেন্টস শ্রমিকরা ন্যূনতম মাসিক মজুরি ৮,০০০ টাকা ($75) থেকে বাড়িয়ে ২৩,০০০ টাকা ($215) করার দাবি করে যাতে করে বর্ধিত বাসা ভাড়া এবং জীবনমানে কঠোরভাবে কমে যাবার ক্ষতিপূরণ করা যায়।

যদিও বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা সরকারের নতুন অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলের সমালোচনা করেছেন, তারা সরকারের ক্রমবর্ধমান দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে সংগঠিত করার বিরোধিতা করেন।

বাংলাদেশ নৌজান শ্রমিক ফেডারেশন, একটি নৌ-পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, একটি বিবৃতি জারি করে সরকারের সমালোচনা করেছে 'সংসদে বিলটি উত্থাপন করার আগে অংশীদারদের সাথে'-অর্থাৎ, ইউনিয়ন আমলাতন্ত্রের সাথে কোনো আলোচনা না করায় - ভবিষ্যতে বিক্ষোভের একটি অস্পষ্ট হুমকি দিয়েছে।

চিকিত্সক এবং নার্সরা 'অত্যন্ত বৈধ' দাবি নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। 'প্রয়োজনীয় পরিষেবা বজায় রাখার নামে প্রতিবাদ করার মৌলিক অধিকার নিষিদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়,' ইউনিয়ন বলেছে। এই আইনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে, যা প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে।

সরকারের কঠোর পদক্ষেপের পূর্ববর্তী পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে ইউনিয়নগুলির ডাকা অনুরূপ বিবৃতি এবং নিরীহ প্রতিবাদ নিরর্থক প্রমাণিত হয়েছে।

২০২২ সালের অক্টোবরে, হাসিনা সরকার দেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন ফেডারেশন শ্রমিক কর্মী ঐক্য পরিষদ (ইউনাইটেড ফ্রন্ট অফ ওয়ার্কার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ) এর প্রতিবাদ উপেক্ষা করে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা আইনের পূর্ববর্তী সংস্করণ পাস করে। সরকারের পতন ঘটাবার জন্য শ্রমিকদের একত্রিত করার পরিবর্তে, ফেডারেশন বিলটি বাতিলের আবেদন করেছিল, সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল যে 'বিদ্যমান আইনে ধর্মঘট নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে।'

বাংলাদেশ এখন অনেক প্রশংসিত 'অর্থনৈতিক অগ্রগতি' হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে বাড়তি আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি। বিশ্বব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য দেশের বৃদ্ধির হার ৬.৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.২ শতাংশ করেছে, যখন মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৩ শতাংশে পৌঁছেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ $৩১.১৪ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, নিউ এজ-এর ১০ই এপ্রিলের সম্পাদকীয় লিখেছে: 'অতীতে, অতি ধনী জনসংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল' তবে সতর্ক করেছে যে ৩৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি বা জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

বাংলাদেশের উপর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, এখন বৈদেশিক মজুত কমে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক উত্তেজনার মুখোমুখি, শ্রীলঙ্কার সাথে সমান্তরাল যেখানে আর্থিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং গত বছর ব্যাপক সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের বিস্ফোরণ রাষ্ট্রপতি রাজাপাক্ষ ও তাঁর শাসন ব্যাবস্থকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।

হাসিনা সরকার একই ধরণের নিপীড়নমূলক অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ধর্মঘটের নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য গণতন্ত্রবিরোধী আক্রমণগুলিকে প্রতিলিপি করছে যা বিক্রমাসিংহের সরকার দ্বারা প্রয়োগ করা হচ্ছে কারণ এটি আইএমএফ দ্বারা নির্দেশিত 'নিষ্ঠুর পরীক্ষা' চাপিয়েছে। নিঃসন্দেহে ফ্রান্সের বিস্ফোরক পরিস্থিতিকে নার্ভাসভাবে দেখছেন, যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক এবং যুবক বার্ধক্য পেনশনের উপর প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রণের আক্রমণের বিরুদ্ধে তিন মাস ধরে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

Loading