বাংলা

ভারত সরকার ওড়িশায় ভয়ঙ্কর ট্রেন বিপর্যয়ের জন্য বলির পাঁঠা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার এবং পুরো শাসক গোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে রেল পরিকাঠামোর প্রতি অবহেলা এবং খরচ কমানোর জন্য তাদের দায় ঢাকার মরিয়া চেষ্টা করছে যার কারণে গত শুক্রবার পূর্ব ভারতীয় রাজ্য ওড়িশায় তিনটি ট্রেনের মধ্যে দুর্ঘটনা হয়েছিল। বালাসোর বিপর্যয় – সিকি শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে যা ভারতে সবচেয়ে ভয়াবহ, যার জন্য - প্রায় ৩০০ যাত্রী নিহত এবং ১,০০০ জনেরও বেশি আহত হয়৷

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশা রাজ্যের ভুবনেশ্বরের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস হাসপাতালে, বালাসোরে শুক্রবারের ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মীয়রা মৃতদেহ শনাক্ত করার চেষ্টা করছে।মঙ্গলবার, 6 জুন, 2023, [AP Photo]

সংবাদ মাধ্যম এখনও মৃতদের মধ্যে প্রিয়জনদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে নিহতদের বিপর্যস্ত পরিবারগুলির প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে। স্বল্প কর্মী নিয়ে হাসপাতালগুলি অত্যধিক আহত যাত্রীদের চিকিত্সার জন্য লড়াই করছে।

'হাসপাতালের বাইরে, দুটি বড় স্ক্রীনে মৃতদেহের ফটো টাঙিয়ে রাখা হয়েছে, মুখগুলি এত রক্তাক্ত এবং পোড়া যে তাদের সনাক্ত করা কঠিন,' অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বলেছে, অনেক মৃতদেহের দাবি করা হয়নি তাও উল্লেখ করেছে।

'আমি সব হাসপাতালে গিয়েছি এবং আমি কিছুই খুঁজে পাইনি,' লালতি দেবী সিএনএনকে বলেন। তিনি তার ২২ বছর বয়সী ছেলেকে খুঁজছিলেন। আরও অনেকেই এইরকম একই করুণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

যদিও প্রেস রিপোর্ট করেছে যে দুর্ঘটনায় ১,০০০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছে, বিশদে বিবরণ খুব অল্পই রয়েছে। আঘাতের পরিমাণ সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত অবশ্য অনুশুমান পুরোহি দিয়েছিলেন, যারা বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। 'আমি আসলে মানবতার হাহাকার শুনেছি, যন্ত্রণায় কান্নাকাটি করছে, জলের জন্য এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল,' তিনি সিএনএনকে বলেছেন।

“লাইনের উপরেই অনেক লোক ছিল, তারা আহত হয়েছিল, সর্বত্র রক্ত ছিল, হাড় ভাঙা ছিল, এবং আমাদের তখন নিজেদের সম্পর্কে চিন্তা বন্ধ করার সময় এবং আহতদের সাহায্য করার সময়… এটি ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ, এটি এমন অবস্থা ছিল যা আমি সত্যিই বর্ণনা করতে পারি না... আমি শরীর ছাড়া একটি মাথা দেখেছি, আমি মাথার খুলি চূর্ণ হওয়া দেখেছি, আমি মৃতদেহগুলিকে ধাতু দ্বারা সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ হওয়া দেখেছি, এটি ভয়ঙ্কর ছিল।'

৪ই জুন, হিন্দু একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে যার শিরোনাম, 'বরিষ্ঠ কর্মকর্তা ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় রেলওয়ের সিগন্যালিং সিস্টেমে গুরুতর ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করেছেন।' গল্পটি দক্ষিণ ভারতের মহীশূর বিভাগের বিরুর-চিকজাজুর সেকশনের হোসাদুর্গা রোড স্টেশনে একটি 'গুরুতর অনিরাপদ ঘটনা' নিয়ে প্রধান সিগন্যাল এবং টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারকে প্রিন্সিপল চিফ অপারেশন ম্যানেজার হরি শঙ্করের কাছে একটি চিঠির উল্লেখ করেছে যা চলতি বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারির।

ওড়িশার ঘটনার মতো, সর্ম্পক ক্রান্তি এক্সপ্রেসকে একটি লাইনে যাওয়ার জন্য একটি সংকেত দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পথটি অন্য লাইনে পরিবর্তন হয়ে যায় যেখানে একটি মালবাহী ট্রেন ছিল। ট্রেনের লোকোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারের সতর্কতার কারণে দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায়, যিনি এটিকে থামিয়ে দিয়েছিলেন।

শঙ্করের চিঠিতে সতর্ক করা হয়েছে: 'বর্তমান ঘটনাটিকে অবশ্যই খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত এবং সিস্টেমের ত্রুটিগুলি সংশোধন করার জন্য অবিলম্বে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং একটি বড় দুর্ঘটনার দিকে নিয়ে যাওয়া শর্টকাটগুলিতে না যাওয়ার জন্য কর্মীদের সংবেদনশীল করা প্রয়োজন।' গত শুক্রবারের দূঃখজনক ঘটনাটি সঠিকভাবে এই কারণেই ঘটেছে কারণ এই সতর্কতা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী মোদি, ওড়িশার বিপর্যয়ের জন্য তাঁর সরকারের দায় ঢাকর স্পষ্ট প্রয়াসে ঘোষণা করেন, 'যেই ভুল করে থাকুক না কেন, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

প্রকৃতপক্ষে, মোদি এবং রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ইতিমধ্যেই একটি মঞ্চ তৈরি করেছেন যে কীভাবে ট্রেন দুর্ঘটনার যে কোনও 'তদন্ত' কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) কে জড়িত করার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবে৷ আসলে, রেল মন্ত্রক তার অনুসন্ধানগুলি শেষ করার অনেক আগেই সোমবার সিবিআইকে নিজস্ব তদন্ত শুরু করার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় রাজস্ব সচিব E.A.S. শর্মা CIB-এর দ্রুত সম্পৃক্ততাকে চ্যালেঞ্জ করে ওয়্যারকে বলেছেন: 'আমার কাছে, এটি রেল মন্ত্রকের স্তরে প্রশাসনের ব্যর্থতার বৃহত্তর সমস্যাগুলি সম্পর্কে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার একটি পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।'

মোদি এবং তার রেলমন্ত্রী এখন মরিয়াভাবে ক্ষতি-নিয়ন্ত্রণের অনুশীলনে জড়িত। তারা উদ্বিগ্ন যে ট্রেন বিপর্যয় সরকারের বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

মোদি প্রশাসন এবং পূর্ববর্তী ভারত সরকার কয়েক দশক ধরে সচেতনভাবে অত্যাবশ্যক পরিষেবা, যেমন বিশাল রেল নেটওয়ার্ক, যা লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার গুনমানের প্রতি অবহেলা করেছে। প্রতি বছর এই নেটওয়ার্ক জুড়ে বিস্ময়করভাবে ৮.৪ বিলিয়ন যাত্রী ভ্রমণ করে।

শ্রমিক এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের পরিবহন নিরাপত্তার প্রতি অবজ্ঞা, যারা ব্যক্তিগত যানবাহন বা বিমান ভ্রমণের সামর্থ্য রাখে না, ভারতের শাসক অভিজাতরা 'মানবীয় ত্রুটি' এবং 'সংকেত ব্যর্থতা' প্রতিরোধ করে এমন উন্নত প্রযুক্তির সম্পূর্ণ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। রেলের আধিকারিকরা স্বীকার করেছেন যে শুক্রবারের দুর্ঘটনাটির রেলপথে 'কবচ' অ্যান্টি-কলিশন সিস্টেম উপলব্ধ ছিল না।

২০১২ সালে, প্রেস রিপোর্ট করেছে যে রেল মন্ত্রক নিরাপত্তা পর্যালোচনা এবং উন্নতির পরামর্শ দেওয়ার জন্য ডঃ অনিল কাকোদকরের সভাপতিত্বে একটি উচ্চ-স্তরের কমিটি নিযুক্ত করেছে।

কমিটি ২০০ বিলিয়ন টাকা আনুমানিক খরচে পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯,০০০ কিলোমিটার পুরো ট্রাঙ্ক রুটের দৈর্ঘ্যের জন্য একটি অ্যাডভান্সড সিগন্যালিং সিস্টেম (ইউরোপীয় ট্রেন কন্ট্রোল সিস্টেমের মতো) গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এক দশকেরও বেশি সময় পরে, এই বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত, এখনও ৬,৫০৬টির মধ্যে ১১০টি রেলস্টেশন বাকি রয়েছে যেগুলিকে উন্নত সংকেত সিস্টেমে আপগ্রেড করা হয়নি।

ভারতীয় রেলওয়েতেও গুরুতরভাবে কম কর্মী থাকা, এই ব্যাবস্থার বিপজ্জনক অবস্থার আরেকটি প্রধান কারণ। রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব সংসদে স্বীকার করেছেন যে রেলওয়েতে ৩,০০,০০০ এরও বেশি অপূর্ণ শূন্যপদ রয়েছে, যার মধ্যে ৭৭,০০০ এরও বেশি সিগন্যাল, টেলিযোগাযোগ, ট্রাফিক এবং পরিবহন বিভাগের।

ফেব্রুয়ারিতে ইকোনমিক টাইমস গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০২৩-এ ভাষণ দেওয়ার সময়, মোদি ভারতে তাঁর সরকারের 'পরিকাঠামোগত সুবিধাগুলি পুনর্নির্মাণে দক্ষতা' সম্পর্কে গর্ব করেছিলেন৷ যদিও ওড়িশার দুর্ঘটনা মোদির লোক দেখানো দাবির একটি বিশেষভাবে দুঃখজনক প্রকাশ, এটি অনেকগুলি পরিকাঠামোগত বিপর্যয়ের মধ্যে একটি মাত্র।

শুক্রবারের ট্রেন দুর্ঘটনার কয়েকদিন পর, পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত চার লেনের কংক্রিটের সেতুটি মাত্র এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার ধসে পড়ে। যদিও কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, তবে এটি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে যদি এটি ধসে পড়ত তবে এটি শত শত মৃত্যুর সাথে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় হত।

গত বছর মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটে একটি সেতু ভেঙে পড়ে, প্রায় ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। শুধুমাত্র গত তিন বছরে ভারতে পূর্বের উল্লেখিত দুটি সহ দশটি সেতু ভেঙে পড়েছে, যার প্রধান কারণ দুর্বল নির্মাণ।

ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েব সাইট তার ৫ই জুন পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করেছে: “[টি] অনেক দেশে রেলকর্মীদের অভিজ্ঞতা হল যে এমনকি যখন সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি চালু করা হয়, তখনও এটি রেলপথ পরিচালনাকে নিরাপদ করার জন্য ব্যবহার করা হয় না, বরং এটি ব্যবহৃত হয় রেলের কর্তা এবং তাদের আর্থিক সহায়তাকারীদের লাভ বৃদ্ধির জন্য। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা উভয় ক্ষেত্রেই প্রিসিশন-শিডিউলড রেলরোডিং (PSR) এর উদ্দেশ্য ছিল, যেটি রেলপথের ক্রুদের শিল্পের ক্রীতদাস মর্যাদায় হ্রাস করতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা ২৪/৭ যে কোন সময় ডাকলেই কাজ করতে বাধ্য করে।'

Loading