বাংলা

প্যালেস্তীনি অভ্যুত্থানে নেতানিয়াহুর শাসন বিহ্বল

প্যালেস্তানিরা গাজায় ইজরায়েলি বিমান বাহিনীর দ্বারা আঘাত করা একটি ভবনের ধ্বংসস্তুপ পরিদর্শন করছে। শনিবার, ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ [AP Photo/Fatima Shbair]

'একজন ক্রীতদাস-মালিক যে চতুরি ও হিংসতার মাধ্যমে একজন দাসকে শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে, এবং একজন ক্রীতদাস যে ধূর্ততা বা হিংসতার মাধ্যমে শিকল ভেঙে দেয়- উপেক্ষণীয় নপুংসকরা যেন আমাদের না বলে যে নৈতিকতার আদালতের সামনে তারা উভয়েই সমান!'- লিও ট্রটস্কি, 1938

শুক্রবার রাতে, গাজা উপত্যকায় প্যালেস্তীনি বাহিনী একটি আশ্চর্য আক্রমণ শুরু করে, ক্রমাগত রকেট হামলা চালায় এবং গাজা উপত্যকা ঘিরে থাকা ইসরায়েলি বাহিনীকে আক্রমণ করে। শনিবার রাত পর্যন্ত, সেখানে ২০০ ইসরায়েলি নিহত এবং ১,১০০ জন আহত এবং ২৩২ জন প্যালেস্তীনি নিহত এবং ১৬৯৭ জন আহত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) পাল্টা আক্রমণ করছে, এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজাকে রক্তের একটি 'অভূতপূর্ব মূল্য' চোকানোর ভয় দেখিয়েছেন।

শুক্রবার রাতে যা শুরু হয়েছে তা হল হিংস্র ও নিষ্ঠুরভাবে নিপীড়ক ইজরায়লি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্যালেস্তীনি জনগণের বিদ্রোহ। নেতানিয়াহু সরকার ফ্যাসিস্ট ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা প্যালেস্তীনি জমি ক্রমাগত চুরির অনুমোদন দিয়েছে, গাজা উপত্যকা অবরোধ করেছে, ক্ষমতাসীন হামাস দলের সদস্যদের হত্যার জন্য নিশানা করেছে এবং আল-আকসা মসজিদে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগঠিত উস্কানি দিয়েছে। গাজার ওপর অসহনীয় শর্ত আরোপ করে সশস্ত্র প্রতিরোধকে অনিবার্য করে তুলেছে।

ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট ওয়েব সাইট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের গাজায় ইজরায়েলের আক্রমণকে সমর্থন করার সময় প্যালেস্তীনি প্রতিরোধকে 'সন্ত্রাস' হিসাবে নিন্দা করার এমন জঘন্য এবং অশ্লীল ভণ্ডামিপূর্ণ বক্তব্যের নিন্দা করে।

গাজার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সামরিক অভিযানের জন্য 'পাথরের মত-দৃঢ় এবং অটুট' সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বাইডেন বলেছেন: 'যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীনভাবে গাজা থেকে হামাস সন্ত্রাসীদের দ্বারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে এই ভয়ঙ্কর হামলার নিন্দা করে এবং আমি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে স্পষ্ট জানিয়েছি যে আমরা ইজরায়েলের সরকার এবং জনগণকে সমস্ত উপায়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত। সন্ত্রাস কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। ইজরায়েলের নিজেকে এবং তার জনগণকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।”

জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ঘোষণা করেছেন: “ইজরায়েলে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামাসের ঘৃণ্য হিংস্রতা নজিরবিহীন এবং অযৌক্তিক। অবিলম্বে এই সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। ইজরায়েলের সাথে আমাদের পূর্ণ সংহতি রয়েছে।”

এসব বক্তব্যের ভণ্ডামি বিস্ময়কর। বরাবরের মতোই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহানুভূতি অত্যাচারীদের সঙ্গে। নিপীড়িতদের দ্বারা প্রতিরোধের যে কোনও প্রকাশকে উন্মত্ত নিন্দার সাথে স্বাগত জানানো হয়। সংবাদ মাধ্যম এই সত্যটিকে উপেক্ষা করে যে ইজরায়েলি সরকার এক অপরাধীর নেতৃত্বে রয়েছে, যার জোট ফ্যাসিস্ট বর্ণবাদীদের দ্বারা আধিপত্যশীল এবং সংবিধানকে দমন করার প্রচেষ্টায় নিযুক্ত রয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের খবর করতে গিয়ে, অভ্যাসগতভাবে রাশিয়ার দ্বারা 'ক্রিমিয়ার অবৈধ দখল' হিসাবে উল্লেখ করে মিডিয়া কখনই এর নিন্দা করতে ব্যর্থ হয় না । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার ঘোষণা করেছে যে তারা ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য ইউক্রেনের যুদ্ধকে সমর্থন করবে 'যতদিনই এটি লাগুক না কেন।' কিন্তু এটি কখনোই প্যালেস্তীনি জমির বিস্তীর্ণ অংশে ইজরায়েলের অবৈধ দখলের নিন্দা করে না।

গাজার প্যালেস্তীনি জনগণ এবং হামাস সরকারের শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী সমর্থক নেই যা তাদের শত শত বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়ে সজ্জিত করে। প্যালেস্তীনিরা যখন ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়, যেটি প্রতি বছর মার্কিন সামরিক সহায়তায় কয়েক বিলিয়ন ডলার পায়, তারা জানে যে তারা অপ্রতিরোধ্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়।

তবুও প্যালস্তীনি বাহিনীকে বীর হিসেবে অভিহিত করা হয় না, বরং প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ এবং ন্যাটো দেশগুলোর ধামাধরা মিডিয়া দ্বারা সন্ত্রাসী হিসেবে নিন্দা করা হয়। বাস্তবে, ইজরায়েলি রাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করেছে এবং হত্যা করেছে।

শনিবার রাতে, জাতির উদ্দেশে এক ভয়াবহ ভাষণে নেতানিয়াহু 'গাজার বাসিন্দাদের' বলেছেন 'এখনই বেরিয়ে যান, কারণ আমরা সর্বত্র এবং পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাজ করব।' যেহেতু তার সরকার গাজা অবরোধ করে এবং কাউকে ছেড়ে যেতে দেয় না, এটি একটি ঘোষণা যে নেতানিয়াহু গাজার সমগ্র জনগণকে একটি বৈধ নিশানা হিসাবে দেখেন। 'হামাস আমাদের সবাইকে হত্যা করতে চায়' বলে জোর দিয়ে নেতানিয়াহু 'শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার' প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং হামাস যে শহরগুলি পরিচালনা করে সেগুলি 'ধ্বংসের শহরে' পরিণত হবে।

গাজা উপত্যকা ধ্বংস করার এই বর্বর হুমকি নেতানিয়াহুর শাসনের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের সাক্ষ্য দেয়। ইহুদিবাদী শাসনের কয়েক দশক ধরে ডানদিকে স্থানান্তরের শেষ ফল হল তার সরকারে ধর্মীয় জায়োনিস্ট পার্টির মতো হিংসাত্মক উগ্র-ডান গোষ্ঠীগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা। এর সদস্যরা অধিকৃত অঞ্চল থেকে প্যালেস্তীনিদের বিতাড়নের আহ্বান জানায়, ১৯৯৪ সালে প্যাট্রিয়ার্কস গুহা গণহত্যার মতো প্যালেস্তীনিদের হত্যাকে উৎসাহিত করে, আল-আকসা মসজিদ ধ্বংসের দাবি করে এবং আমেরিকান বংশোদ্ভূত ফ্যাসিবাদী মীর কাহানের উত্তরাধিকার হিসাবে প্রচার করে।

তার যুদ্ধের জন্য নেতানিয়াহুর ন্যায্যতা হামাসের উদ্দেশ্যের মিথ্যা প্রমাণের উপর ভিত্তি করে, যেটিকে তিনি গণহত্যাকারী সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করেন। বাস্তবে, হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডের জারি করা বিবৃতিটি ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয় বরং ইজরায়েলি দখলদারিত্বের বিরোধিতার উপর জোর দেয়। ইজরায়েলি সৈন্য এবং বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা প্যালেস্তীনিদের হত্যা, প্যালেস্তীনিদের দীর্ঘমেয়াদী কারাবাস, প্যালেস্তীনি জমি চুরি এবং আল-আকসা মসজিদে উস্কানি দেওয়ার নিন্দা জানিয়ে এটি উপসংহারে আসে:

“যেহেতু ইজরায়েলি দখলদারিত্ব গাজা উপত্যকার অবরোধ বজায় রেখেছে এবং আমাদের প্যালেস্তীনি জনগণের বিরুদ্ধে তার অপরাধ অব্যাহত রেখেছে, মার্কিন ও পশ্চিমা সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক নীরবতার মধ্যে আন্তর্জাতিক আইন ও সিদ্ধান্তের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করে, আমরা সে সব বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমরা ইজরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান ঘোষণা করছি, যা প্যালেস্তীনি জনগণের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের ক্রমাগত অপরাধ এবং আল-আকসা মসজিদে লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে।'

ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের ৫০ বছর পর হামাসের দ্বারা এই ধরনের অপারেশন গোপনে প্রস্তুত করা এবং ৬ই অক্টোবরে এটি শুরু করার ক্ষমতা -ইজরায়েলি রাষ্ট্রের সংকটের গভীরতা প্রকাশ করে। এটি ফ্যাসিবাদী উপাদানগুলির দ্বারা ছেয়ে গেছে, দুর্নীতির জন্য নেতানিয়াহুর একটি বছরব্যাপী বিচারের মুখোমুখি হয়েছে এবং এই বছরের শুরুতে শ্রমিক ও যুবকদের ব্যাপক বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে কারণ এটি বিচার বিভাগের আইনি স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে সাংবিধানিক সংস্কারের চেষ্টা করেছিল এবং ব্যর্থ হয়েছিল৷ ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের মাধ্যমে প্যালেস্তীনি বিরোধিতাকে দমন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

নেতানিয়াহু সরকার প্যালেস্তীনি বিদ্রোহ দেখে অনেকটা বিস্মিত হয়েছিল যেভাবে অধিকৃত পোল্যান্ডের নাৎসি কমান্ডাররা ১৯৪৩ সালের ওয়ারশ ঘেটোতে ইহুদিদের বিদ্রোহ এবং ১৯৪৪ সালের ওয়ারশ বিদ্রোহ দ্বারা বিস্মিত হয়েছিল। তার অহংকার এবং জাতিগত বিদ্বেষ দ্বারা অন্ধ হয়ে, এটি বিশ্বাস করেছিল যে দমনপীড়ন প্যালেস্তীনিদের পিঠকে এতটাই ভেঙে দিয়েছে যে প্রতিরোধ করা অসম্ভব। এর ত্রুটি এখন উন্মোচিত হয়েছে, এটি অগ্রসর হচ্ছে-অধিকৃত পোল্যান্ডের মতো, যেখানে নাৎসিরা বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে- রক্তগঙ্গা বইয়ে।

এই নীতি আরব এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্লজ্জ মিথ্যাচার সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের মধ্যে প্যালেস্তীনিদের জন্য ব্যাপক সহানুভূতি রয়েছে।

এই সহানুভূতি ও বিরোধিতাকে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে হবে। বিশেষ করে, ইজরায়েলের শ্রমিক ও যুবকদের নেতানিয়াহু সরকারের নরঘাতক নীতি থেকে নিজেদেরকে আলাদা করতে হবে ও বিরোধিতা করতে হবে এবং নিপীড়ন ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্যালেস্তীনিদের লড়াইকে সমর্থন করতে হবে।

রক্তাক্ত, সাম্রাজ্যবাদী-সমর্থিত কঠোর আক্রমণ শুরু করার জন্য নেতানিয়াহুর প্রস্তুতিতে দুর্নীতিগ্রস্ত আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের বুর্জোয়া শাসনগুলি জড়িত। তুরস্ক, মিশর, সৌদি আরব এবং এই অঞ্চলের অন্যত্র পুঁজিবাদী সরকারগুলি কঠোরতা না করার এবং সংযমের জন্য আবেদন করছে, যা নেতানিয়াহু উপেক্ষা করবেন। একই সময়ে, তারা সবাই তাদের নিজস্ব সামরিক এবং কৌশলগত কারণে ইজরায়েলি সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে।

যে শক্তি ইজরায়েলে নেতানিয়াহুর আক্রমণকে থামাতে পারে তা হল ইজরায়েলি, প্যালেস্তীনি এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণী, গাজার উপর আক্রমণ বন্ধ করতে, নেতানিয়াহু সরকারের পতন ঘটাতে এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে ইজরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অগ্রসর করে।

Loading