বাংলা
Perspective

ভারতীয় শাসক শ্রেণী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মোদীকে আলিঙ্গন করছে যখন তিনি একটি হিন্দু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলছেন

ভারতের অযোধ্যায় হিন্দু ধর্মের ভগবান রামের মন্দিরের উদ্বোধনের সময় একটি ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করছে।২২শে জানুয়ারী, ২০২৪, [এপি ছবি/রাজেশ কুমার সিং] [AP Photo/Rajesh Kumar Singh]

ভারতের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার সোমবার যেখানে বিখ্যাত বাবরি মসজিদ মসজিদটি প্রায় ৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়েছিল সেই জায়গায় একটি সদ্য-নির্মিত হিন্দু মন্দিরের স্থাপনায় একটি বিশাল অনুষ্ঠান করেছে। ১৯৯২ সালে বিজেপি এবং তার ফ্যাসিবাদী মিত্রদের পক্ষে সংগঠিত হিন্দু মৌলবাদী ধর্মান্ধদের দ্বারা মসজিদটিকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে, সোমবারের কর্মসূচিটি ছিল একটি ঐতিহাসিক অপরাধের উদযাপন এবং আরও বড় কিছু উপলব্ধি করার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ—আর তা হল ভারতকে একটি হিন্দু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা দুর্ভোগের মধ্যে বসবাস করবে এবং শুধুমাত্র তাদের স্বীকারের ভিত্তিতে যে ভারত প্রথম এবং সর্বাগ্রে একটি 'হিন্দু রাষ্ট্র'।

৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা একটি নৃশংসতা যা ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশকে স্পষ্টভাবে এক মুসলিম পাকিস্তান এবং প্রধানত হিন্দু ভারতে বিভক্ত হওয়ার পর ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসতার সবচেয়ে বড় তরঙ্গের সূত্রপাত ঘটায়। দেশভাগে হাজার হাজার নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই দরিদ্র মুসলমান।

তিন দশক পরে, অতি-ডানপন্থী বিজেপি ভারতীয় শাসক অভিজাতদের জাতীয় সরকারের পছন্দের দলে পরিণত হয়েছে। ভারতের ধনকুবেররা যদি মোদী ও গুণ্ডাদেরকে যারা বিজেপির সামনের সারিতে থাকে, তাঁদের আলিঙ্গন করে থাকে তবে তা শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাংবিধানিক সুরক্ষার বিরুদ্ধে নির্যাতন চালানোর জন্য যতে করে 'বিনিয়োগকারী-পন্থী নীতি' এবং নয়া দিল্লির বিশাল ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনুসরণ করতে সুবিধা হয়।

সোমবারের কর্মসূচিটিতে ক্ষুদ্রতম বিষয়গুলি আগেথেকেই বিশদে স্থির করা হয়েছিল - ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়টি লঙ্ঘন করার লক্ষ্যে, হিন্দু উগ্রতাকে উস্কে দিতে, ধর্মীয় পশ্চাদপদতা এবং অযৌক্তিকতা প্রচার করতে এবং হিন্দু শক্তিশালী মোদীকে ঐশ্বরিকতার মঞ্জুরি প্রদান করতে।

মোদি মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন যেটি হিন্দু মন্ত্র এবং আচার-অনুষ্ঠানের একটি বিস্তৃত অংশ যার মাধ্যমে শিশু ভগবান রামের একটি মূর্তি - বাস্তবে একটি বড় পুতুল -কে 'প্রান প্রতিষ্ঠা' করার কথা বলা হয়েছে।

হাজার হাজার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে পরবর্তী জাতীয় টেলিভিশন ভাষণে, মোদি মন্দিরের পবিত্রতাকে কয়েক শতাব্দী ধরে 'মুসলিম' এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে 'দাসত্বের' পর 'হিন্দু জাতির পুনর্জন্ম' বলে ঘোষণা করেন এবং নিশ্চিত করেন যে হিন্দু জাতি এবং ভারত এক।

হিন্দু জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা অবশ্যই একটি বিশাল প্রতারণা। ভারত শ্রেণী দ্বন্দ্বে আক্রান্ত, জনসংখ্যার শীর্ষ থাকা ১ শতাংশ সমস্ত আয়ের ২২ শতাংশ গান্ডে-পিন্ডে গিলে ফেলে, সেখানে কোটি কোটি মানুষকে প্রতিদিন ৩ ডলারেরও (২৪৬ টাকা) কম আয়ে বেঁচে থাকতে হয়। মোদি যখন একটি পৌরাণিক হিন্দু জাতির 'পুনর্জন্ম' ঘোষণা করেন, তখন তিনি আসলে যা উদযাপন করছেন তা হল বিজেপি এবং তার অতি ডানপন্থী মিত্রদের রাজনৈতিক প্রাধান্য।

'এটি কেবল একটি ঐশ্বরিক মন্দির নয়,' মোদী নিশ্চিত করেন। 'এটি ভারতের দৃষ্টি, দর্শন এবং দিক নির্দেশনার একটি মন্দির ... রাম ভারতের চিন্তা, ভারতের আইন ... ভারতের প্রতিপত্তি, ভারতের শক্তি।'

প্রতিক্রিয়ার এই বেলেল্লাপনাকে আশীর্বাদ করেছিলেন কেবল ফ্যাসিবাদী আরএসএসের প্রধানরাই নন, যাদের বেশিরভাগই কর্মসূচিতে মোদীর পাশে ছিলেন, পরন্তু ভারতের ধনকুবেররাও। মুকেশ আম্বানি এবং গৌতম আদানি, যথাক্রমে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী এবং দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তিদের নেতৃত্বে, তারা উত্সবে যোগ দিতে এবং এই বসন্তে যখন ভারতে ভোট হবে তখন মোদী এবং বিজেপির টানা তৃতীয়বার পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়ী হওয়ার প্রচারকে আরও উজ্বলতা দিতে এসেছিলেন। 'ভারতের নতুন যুগের সাক্ষী হতে পারা খুবই সৌভাগ্যের বিষয়,' আম্বানি বলেন।

গার্ডিয়ান, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস এবং জাপান টাইমস সহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের কিছু অংশ ' ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার মৃত্যু' এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই উদ্বেগগুলি সর্বপ্রথম এবং সর্বাগ্রে এই আশঙ্কার কারণে যে মোদি একটি ঝড় ওঠাতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী পুঁজির বিনিয়োগকে বিপন্ন করে তুলতে পারে এবং তার নিরলস সাম্প্রদায়িক উস্কানি 'সর্বগ্রাসী' চীন' এর প্রতিষেধক হিসাবে ভারতকে “গণতান্ত্রিক” হিসাবে তাদের প্রচারের প্রতারণামূলক প্রচেষ্টাকেই প্রকাশ করে।

যে কোন ঘটনার ব্যাপারে, শাসক শ্রেণীর লেখকরা যা লেখেন তা এক জিনিস; তাদের সরকারের নীতি অন্য এক। এক দশক ধরে, মোদির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ২০০২ সালে গুজরাটে -মুসলিমদের গণহত্যার জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তার ভূমিকার কারণে। এতে প্রায় ২,০০০ মুসলমান মারা যায় এবং কয়েক লক্ষ গৃহহীন হয়।

কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে, ওয়াশিংটন, লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস এবং টোকিও সবাই আক্রমণাত্মকভাবে মোদীকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে, এমনকি তার সরকার দ্বারা অন্তহীন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো- যার মধ্যে মুসলিম গরু ব্যবসায়ীদের উপর আক্রমণ থেকে অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে নির্বাসনের পথ প্রশস্ত করতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করা।

তারা এটা করেছে কারণ কৌশলগতভাবে চীনকে ঘিরে ফেলতে এবং যুদ্ধ চালানোর পরিকল্পনার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ভারত।

হিন্দু আধিপত্যবাদী এবং সাম্প্রদায়িক মোদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আলিঙ্গন যেমন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার অতি-ডানপন্থী সরকারের প্রতি যখন এটি গাজায় গণহত্যামূলক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের পূর্ণ সমর্থন করে এবং সেই সাথে ফ্যাসিবাদী শিষ্য স্টেপান বান্দেরার সাথে তাদের জোটের মাধ্যমে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে।

সারা বিশ্বের মতো ভারতেও চরম ডানপন্থীদের কর্মসূচির ব্যাপক বিরোধিতা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শ্রমিকদের জঙ্গি সংগ্রাম এবং কৃষক বিক্ষোভের একটি ঢেউ দেখেছে যা শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের দ্বারা উস্কে দেওয়া সাম্প্রদায়িক, বর্ণ এবং জাতিগত বিভাজনকে বাতিল করে, যার মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর বস্তুনিষ্ঠ ঐক্য প্রদর্শিত হয়েছে।

বৈশ্বিকভাবে, ভারতের মতোই, শ্রমিক শ্রেণী এই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে যে রাজনৈতিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলি তাদের নামে কথা বলার দাবি করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সমর্থন করে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর সংগ্রামগুলিকে শ্বাসরোধ করে, যার ফলে সুদূর ডানপন্থীদের জন্য দরজা খুলে দেয় ক্রমবর্ধমান সামাজিক রাগ এবং হতাশাকে কাজে লাগাবার জন্য। কয়েক দশক ধরে, যমজ স্তালিনবাদী সংসদীয় দল—ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিএম এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)-এবং তাদের বামফ্রন্ট এবং অধিভুক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিক শ্রেণীকে কংগ্রেস পার্টি, ভারতীয় বুর্জোয়াদের ঐতিহ্যবাহী শাসক দল, সেইসাথে ফ্যাসিবাদী বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে ডানপন্থী বর্ণবাদী এবং নৃ-সাম্প্রদায়িক দলগুলির একটি সমষ্টির সাথে যুক্ত করতে ব্যাবহার করেছে।

আজ, তারা নিশানা করে বিজেপির অপরাধকে, ভারতীয় শাসক শ্রেণীকে অভিযুক্ত করে না ও শ্রমিক শ্রেণীকে সংগ্রামের জন্য ডাকও দেয় না, পরন্তু কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া নির্বাচনী জোটের পিছনে এটিকে সংহত করার চেষ্টা করে, যারা 'বিনিয়োগকারী পন্থী' নীতি এবং ভারত-মার্কিন 'বিশ্ব কৌশলগত অংশীদারিত্বের' ব্যাপারে মোদির বিজেপির চেয়ে কম কিছু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। এই তথাকথিত 'ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক জোট'-এর সদস্যদের মধ্যে বিশিষ্ট দলগুলি যারা দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির মিত্র ছিল এবং এমনকি শিবসেনার মতো হিন্দু আধিপত্যবাদের প্রবক্তাও আছে।

ভারতের শ্রমিক ও মেহনতিরা পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠার ডানপন্থী দলগুলি এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিকৃত 'গণতান্ত্রিক' প্রতিষ্ঠানগুলিকে আঁকড়ে ধরে থেকে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার মোকাবেলা করতে পারে না। এই দলগুলি এবং প্রতিষ্ঠানগুলি, যার প্রথমে এবং সর্বাগ্রে কংগ্রেস পার্টি নিজেই, ভারত বিভাজন সহ হিন্দু অধিকার এর সাথে মিলিত হয়েছে এবং খাপ খাইয়ে নিয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার একেবারে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহন করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট একের পর এক রায় জারি করেছে গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর বিজেপির আক্রমণকে সহজতর করে, যার মধ্যে ২০১৯ এর একটি রায় রয়েছে, যেটিকে মোদি তার সোমবারের ভাষণে প্রশংসা করেছিলেন, যা সরকারকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের জন্য 'আদেশ' দিয়েছিল।

হিন্দু আধিপত্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াকে পরাজিত করতে, ভারতের শ্রমিকদের অবশ্যই তাদের সংগ্রামকে সমাজতন্ত্রের লড়াই এবং স্থায়ী বিপ্লবের ট্রটস্কিবাদী যে কর্মসূচি তার উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলতে হবে। বেসরকারীকরণ, অনিশ্চিত চুক্তিবদ্ধ কর্মসংস্থান, ব্যয় কঠোরতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং অনান্য গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত সংগ্রামকে একত্রিত করতে হবে একটি গণ শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আক্রমণের মাধ্যমে। এই ধরনের আক্রমণে প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান উত্থানের বিকাশ এবং এর লক্ষ্য হবে নির্যাতিত মেহনতীদের বুর্জোয়া এবং তাদের সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এবং শ্রমিকদের হাতে ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ে ও আর্থ-সামাজিক জীবনের সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধ করা।

Loading